হীরা-পানি ধাঁধা – মূল্যের আপাত অসামঞ্জস্যতা

Diamond-Water Paradox: Price paradox

মানুষের জীবন ধারনের জন্য পানি অত্যাবশকীয় এবং পানির ভোগও বেশি। তাই মোট উপযোগও বেশি। কিন্তু পানির দাম অত্যন্ত কম। অন্যদিকে মানুষের জীবন ধারনের জন্য হীরক অত্যাবশকীয় নয়। হীরকের ব্যবহারিক মূল্যও কম। ব্যবহার কম হওয়ায় মোট উপযোগও কম। কিন্তু হীরার দাম অত্যন্ত বেশি। কিন্তু কেন? অত্যাবশকীয় না হওয়া সত্ত্বেও হীরার দাম বেশি এবং অত্যাবশকীয় হওয়া সত্ত্বেও পানির দাম কম – এই লক্ষ টাকা দামের প্রশ্নটিই হীরা-পানি ধাঁধা।

হীরা-পানি ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আর একটি প্রশ্ন হাজির হয় – তাহলে কি পণ্যের উপযোগের সাথে দামের কোন সম্পর্ক নাই?

উপযোগের সাথে দ্রব্যের দামের সম্পর্ক আছে।

যদি উপযোগের সাথে দামের সম্পর্ক থাকে তাহলে সে সম্পর্ক দিয়ে হীরা-পানি ধাঁধার সমাধান করা যাচ্ছে না কেন? নাকি এটি একটি ব্যতিক্রম?

দ্রব্যের মোট উপযোগের সাথে তার মূল্যের সম্পর্কের প্রবক্তা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকের ক্লাসিকাল অর্থনীতিবিদগণ হীরা ও পানির দামের ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। তাই তাঁরা এটিকে ‘হীরা ও পানির দামের আপাতবিরোধীতা’ নামে বা ব্যতিক্রম হিসাবে অভিহিত করেন। প্রান্তিক উপযোগ ও দামের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন দ্বারা হীরা-পানি ধাঁধা বা দ্রব্যের মূল্যের আপাত বিরোধিতার অবসান ঘটে।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ওয়ালরাস, জেভন্স প্রমুখ নয়া ক্লাসিক অর্থনীতিবিদগণ একটি আধুনিক উপযোগ তত্ত্বের অবতারণা করেণ। তাঁদের মতে, কোন দ্রব্যের দাম তার প্রান্তিক উপযোগের উপর নির্ভর করে মোট উপযোগের উপর নয়। ফলে যে দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ বেশি তার দামও বেশি আর যে দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ কম তার দামও কম। এই মতবাদের দ্বারা পণ্যের উপযোগের সাথে দামের সম্পর্ক যেমন ঠিক থাকে আবার হীরা ও পানির দামের আপাত বিরোধিতারও নিস্পত্তি ঘটে।

যে দ্রব্যের যোগানের পরিমান বেশি তার প্রান্তিক উপযোগ কম । কারণ যোগান বেশি হওয়ায় সেই দ্রব্যের এককের সংখ্যাও বেশি। ফলে দ্রব্যের একক যতই বাড়ানো হয়, তার প্রান্তিক উপযোগ ততই কমে আসে। কিন্তু মোট উপযোগ বেড়ে যায়।

নিচের ছকে তা দেখানো হল-

ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ

ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ

অপরদিকে যে দ্রব্যের যোগান যত কম সে দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ তত বেশি। কিন্তু যোগান কম হওয়ায় মোট উপযোগও কম থাকে।

মানুষের জীবন ধারনের জন্য পানি অত্যাবশকীয় যার যোগান অত্যন্ত বেশি, ফলে তার প্রান্তিক উপযোগ কম। প্রান্তিক উপযোগ কম বলে পানির দামও কম। তবে এক্ষেত্রে পানির মোট উপযোগ বেশি। কিন্তু মোট উপযোগের উপর দাম নির্ভর করে না। প্রান্তিক উপযোগের উপর দাম নির্ভর করে বলেই পানির দাম কম।

অন্যদিকে হীরক যার যোগান অত্যন্ত কম এবং ব্যবহারিক মূল্যও কম। হীরার যোগান কম হওয়ায় মোট উপযোগ কম, কিন্তু প্রান্তিক উপযোগ বেশি। প্রান্তিক উপযোগ বেশি বলেই হীরার দামও বেশি।

চিত্রের সাহায্যে হীরা-পানি ধাঁধা ব্যাখ্যা

নিচের চিত্রের সাহায্যে হীরা-পানি ধাঁধা তথা মূল্যের আপাত বিরোধিতা ব্যাখ্যা করা হল-

হীরা-পানি ধাঁধা

চিত্রঃ হীরা-পানি ধাঁধা

চিত্রের OX অক্ষে দ্রব্যের পরিমান এবং OY অক্ষে প্রান্তিক উপযোগ ও দাম পরিমাপ করা হয়েছে। DD হচ্ছে হীরকের প্রান্তিক উপযোগ তথা দাম রেখা এবং WW হচ্ছে পানির প্রান্তিক উপযোগ তথা দাম রেখা।

ধরি, হীরকের সম্ভাব্য যোগান OD এবং পানির সম্ভাব্য যোগান OW।

হীরকের যোগান কম বলে তার প্রান্তিক উপযোগ বেশি। অন্যদিকে, পানির যোগান বেশি বলে তার প্রান্তিক উপযোগ কম।

হীরকের যোগান যখন ON তখন হীরকের প্রান্তিক উপযোগ LN। পানির যোগান যখন ON1 তখন এর প্রান্তিক উপযোগ KN1। প্রান্তিক উপযোগ ও দাম পরস্পর সমান হওয়ার কারণে হীরার দাম (PD) যা LN এর সমান এবং পানির দাম (PW) যা KN1 এর সমান। ON পর্যন্ত হীরার মোট উপযোগ ONLM এবং পানির মোট উপযোগ ON1KM1

চিত্র হতে লক্ষনীয় যে পানির মোট উপযোগ (OM1KN1), হীরার মোট উপযোগ (ONLM) অপেক্ষা অনেক বেশি। কিন্তু হীরার প্রান্তিক উপযোগ (MUD), পানির প্রান্তিক উপযোগ (MUW) এর চেয়ে বেশি। ফলে হীরার দাম (PD), পানির দাম (PW) থেকে বেশি।

যেহেতু দাম নির্ধারণে মোট উপযোগের কোন ভূমিকা নাই, তাই পানি মানুষের জীবন ধারণের জন্য এত প্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও পানির দাম খুবই কম; কিন্তু হীরার দাম খুবই বেশি। এভাবে প্রান্তিক উপযোগ ও দামের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে হীরা-পানি ধাঁধা তথা হীরা ও পানির দামের আপাত অসামঞ্জস্যতা সমাধান হয়।