সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য

সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য

আধুনিক কালে সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য খুবই ব্যাপক। সামষ্টিক অর্থনীতি দেশের অর্থ ব্যবস্থার বিভিন্ন খাত বা এককসমুহকে (কৃষি, শিল্প, সেবা, পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি) সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে (সামগ্রিক বা দেশীয় আঙ্গিকে – ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দিক থেকে বিবেচনা না করে) বিচার বিশ্লেষণ করে। নিম্নে সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমুহ আলোচনা করা হলো।

অর্থনৈতিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের উপায় নির্দেশ করাঃ

সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিভিন্ন অর্থনৈতিক চলকসমুহের কার্যকারণ সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়া (Interaction) নির্ণয় করে তার ভিত্তিতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের পথ নির্দেশ করা হয়। (সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলকসমুহ – জাতীয় আয়, ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, দামস্তর, সুদের হার, সরকারি ব্যয়, নীট রপ্তানি।) এটি সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য এর মধ্যে অন্যতম প্রধান।

সর্বোচ্চ জিএনপি অর্জনঃ

এটি সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য সমুহের মধ্যে দ্বিতীয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছর) একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে যে চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা (ব্যবহার উপযোগী দ্রব্য ও সেবা যা ভোক্তার ভোগের জন্য উপযুক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে) উৎপাদন করা হয়, তার বাজার মূল্যের সমষ্টিকে জিএনপি বলা হয়।

জিএনপি একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরে। যে দেশে জিএনপি-এর পরিমান বা আকার বড় সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য এর  অন্যতম হলো জিএনপি’র সঠিক পরিমান নির্ণয় করা এবং জিএনপি গ্যাপ কমিয়ে এনে সর্বোচ্চ জিএনপি অর্জনের পথ নির্দেশ করে দেশের অর্থনৈতিক কল্যান সর্বোচ্চ করা।

সামষ্টিক চলকসমুহের ভারসাম্যঃ

সামষ্টিক চলকসমুহের ভারসাম্য

সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য সমুহের মধ্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হল  সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিভিন্ন চলকের ভারসাম্য মান বের করা। যেমন ভারসাম্য জাতীয় আয় স্তর (আয় কমে গেলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে, আয় বেশি বেড়ে গেলে অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে);

ভারসাম্য ভোগ স্তর (ভোগ কমে গেলে চাহিদা কমে যাবে এবং উৎপাদক উৎপাদন কমাতে বাধ্য হবে, ভোগ বেড়ে গেলে সঞ্চয় কমে যাবে);

ভারসাম্য সঞ্চয় (সঞ্চয় কমে গেলে বিনিয়োগ কমে যাবে এবং সঞ্চয় বেড়ে গেলে ব্যয় যোগ্য আয় কমে যাবে);

ভারসাম্য বিনিয়োগ (বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে, আবার বিনিয়োগ বাড়লে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে সরবরাহ বেড়ে যাবে, অতিরিক্ত সরবরাহ হলে দাম কমে যাবে, মুনাফা কম হবে),

ভারসাম্য কর্মসংস্থান (কর্মসংস্থান কমে গেলে বা বেকারত্ব বেড়ে গেলে জিডিপি কমে যাবে এবং কর্মসংস্থান বেড়ে বেকারত্ব শূন্যের কোঠায় পৌঁছালে শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে),

ভারসাম্য দামস্তর (দামস্তর কমে গেলে মুনাফা কমে যাবে, উৎপাদক উৎপাদনে উৎসাহ হারাবে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কম হবে এবং দামস্তর বেড়ে গেলে মানুষের প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে, অতিরিক্ত মুনাফার ফলে এক শ্রেনির মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হবে),

ভারসাম্য সুদের হার (সুদের হার কমে গেলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে এবং সুদের হার বেড়ে গেলে মুদ্রাসংকোচন দেখা দেবে),

ভারসাম্য সরকারি ব্যয় (সরকারি ব্যয় কমে গেলে সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজ সংকুচিত হবে এবং সরকারি ব্যয় বেড়ে গেলে জনগণের উপর করের বোঝা বৃদ্ধি পাবে),

ভারসাম্য নীট রপ্তানি (নির্দিষ্ট সময়ে কোন দেশের রপ্তানি ও আমদানির মধ্যে পার্থক্যকে বলে নীট রপ্তানি। নীট রপ্তানি কম হলে অর্থাৎ রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি দেখা দেবে এবং নীট রপ্তানি বেশি হলে অর্থাৎ রপ্তানির তুলনায় আমদানি কম হলে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও দাম বৃদ্ধি পাবে) ইত্যাদি নির্ণয় করা।

মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব নিয়ন্ত্রণঃ

সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম ২টি বড় বাঁধা হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতিবেকারত্ব। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য এর অন্যতম উদ্দেশ্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও বেকারত্ব কমিয়ে আনা। এজন্য মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণ অনুসন্ধান ও প্রভাব নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের মত জটিল পথ বের করতে হয়।

কর্মসংস্থান সৃষ্টিঃ

কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করতে পারলে বেকারত্ব রোধ করা সম্ভব নয়। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির উদেশ্য । কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তরান্বিত করার উপায় খুঁজে দেয়া। বেকারত্বকে বলা হয় অপূর্ণ বিনিয়োগ। এই অপূর্ণ বিনিয়োগকে পূর্ণ বিনিয়োগে রূপান্তরের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আয়স্তর বৃদ্ধি সাধিত হয়।

আয়ের সুষম বণ্টনঃ

মোট জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন না হয়ে যদি তা মুষ্টিমেয় কয়েক জনের হাতে চলে যায় তাহলে সম্পদ কুক্ষিগত হয় এবং জনকল্যাণে কাজে আসে না। সেক্ষেত্রে জিডিপি বা জিএনপির আকার বড় হলেও তা স্থিতিশীল হয় না এবং ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্ম দেয়। সমাজের অধিকাংশ মানুষের আয়স্তর দামস্তরের নিচে থাকায় মোট ভোগ ও চাহিদা কমে যায়। তখন নেগেটিভ ফিডব্যাকের কারণে উৎপাদনও কমে যায়।

(উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে উৎপাদক নতুন পণ্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হয় এবং চলতি উৎপাদনও বন্ধ রাখে।)

মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতাঃ

মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে পারে না। মুদ্রাস্ফীতি অথবা মুদ্রাসংকোচন দেখা দিলে সমাজে কিছু লোক উপকৃত হয় আবার কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। (মূল্যস্ফীতির ফলে ক্রেতার প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়, বিক্রেতা বা উৎপাদক লাভবান হয়।)

মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচনের ফলে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় – যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। গতিশীল অর্থনীতির জন্য নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি কাম্য। তাই আর্থিক নীতি ও রাজস্বনীতি এমন ভাবে প্রণয়ন করা দরকার যাতে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকে।

সামষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি প্রণয়নে সহায়তা করে মূল্যস্তর স্থিতিশীল রেখে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।

অর্থনৈতিক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানঃ

আধুনিক কালে সরকার অর্থের যোগান বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করে। যেমন বর্তমান করোনায় অর্থনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সরকার বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিয়ে উৎপাদন, ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ও মূল্য স্তর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তাই আধুনিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যঃ

একটি দেশের জনগনের সাথে অন্যান্য সকল দেশের জনগনের মধ্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক লেনদেন হয়ে থাকে। একে বৈদেশিক লেনদেন বলে। এর ভিতরে আছে আমদানি, রপ্তানি ও মূলধনের প্রবাহ। বৈদেশিক লেনদেন সবসময় ভারসাম্য অবস্থায় থাকে না। কখনও অর্থের বহিপ্রবাহ আন্তপ্রবাহ অপেক্ষা বেশি হয়, তাকে বলা হয় বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি।

(রপ্তানি আয় অপেক্ষা আমদানি ব্য বেশি হলে অর্থাৎ দেশ থেকে বেশি টাকা বাইরে গেলে এবং কম টাকা দেশে প্রবেশ করলে সেটি বৈদেশিক বানিজ্য ঘাটতি)

আবার কখনও বৈদেশিক লেনদেনে উদ্বৃত্তও দেখা যায় (যত টাকা বাইরে গেল তার থেকে বেশি টাকা প্রবেশ করল)।

বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি একটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি দুর্বল হয়। তাই এমনভাবে আমদানি রপ্তানি নীতি বা বৈদেশিক লেনদেন নীতি প্রনয়ন করতে হবে যাতে বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য বজায় থাকে।

এটিও সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য ।

উপসংহারে বলা যায় সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার সমস্যা চিহ্নিত করা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলক সমুহের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য নীতি প্রণয়ন করা ইত্যাদি সামষ্টিক অর্থনীতির উদেশ্য। সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য হল সর্বোচ্চ জনকল্যাণে সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করা ।

সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদেশ্য