লাল চাল বা রেড রাইস

লাল চাল দেখতে লালচে বাদামী। রান্নার পরে ভাতের রং হয় গোলাপী। অ্যান্থোসায়ানিন নামক যৌগের কারণে এই চালের রং লাল হয়। অ্যান্থোসায়ানিন এক ধরণের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যা লাল এবং বেগুনি রঙের শাক-সব্জি ও ফলে পাওয়া যায়। লাল চালের ভাতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং আয়রন থাকে। ফলে এটি প্রদাহ কমায়, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে এবং উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করতে সহায়তা করে। লাল চালের ভাত হজম করতে বেশি সময় লাগে বলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে ওজন হ্রাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাদামী চাল বা ব্রাউন রাইস

ধান থেকে খোসা  বা তুষ ছাড়িয়েই যে চাল পাওয়া যায় সেগুলোই মূলত ব্রাউন রাইস বা বাদামী চাল। এতে কুড়া অংশ চাল থেকে ছাড়ানো হয় না বলে। ফলে চালের পুষ্ঠি গুণ সম্পূর্ণ অটুট থাকে। সেজন্য বাদামী চালের ভাত সাদা চালের ভাতের চেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ।

পরবর্তী আলোচনায় আমি সাদা চালের বিপরীতে লাল চাল ও বাদামী চালকে একসাথে লাল চাল অথবা বাদামী চাল বলব।

সাদা চাল বা হোয়াইট রাইস

উপমহাদেশে সর্বাধিক প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত হয় সাদা চালের ভাত। সাদা চাল উচ্চস্তরের পরিশোধনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। ফলে চালের আঁশ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও প্রোটিন জাতীয় প্রয়োজনীয় পুষ্টি হারাতে হয়। সাদা চালের ভাতে পুষ্টি কম, ক্যালরী বেশি।

লাল চাল ও সাদা চালের পার্থক্য

প্রতি ১০০ গ্রাম চালের বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদানের তালিকা:

পুষ্টি উপাদানলাল চালসাদা চাল
থায়ামিন০.৬ মিলি গ্রাম০.১ মিলি গ্রাম
রিবোফ্লাভিন০.১৪ মিলি গ্রাম০.০৬ মিলি গ্রাম
নায়াসিন৫ মিলি গ্রাম২ মিলি গ্রাম
ভিটামিন বি৫১.৩ মিলি গ্রাম০.৭ মিলি গ্রাম
আয়রন৪.৭ মিলি গ্রাম২.২ মিলি গ্রাম
সোডিয়াম১৩ মিলি গ্রাম৬.৫ মিলি গ্রাম
ম্যাঙ্গানিজ৩.২ মিলি গ্রাম২.৫ মিলি গ্রাম
ম্যাগনেশিয়াম১৩৩ মিলি গ্রাম১২ মিলি গ্রাম
পটাশিয়াম৩২০ মিলি গ্রাম১২০ মিলি গ্রাম
ভিটামিন-ই২ মিলি গ্রাম০.৩ মিলি গ্রাম
সেলেনিয়াম৭৮ মাইক্রো গ্রাম৭ মাইক্রো গ্রাম
শর্করা৪৯.৫ গ্রাম৮০ গ্রাম
ক্যালরি২৩৮  কিলোক্যালরি৩৬৫ কিলোক্যালরি
ফ্যাট বা স্নেহ১.৬ গ্রাম০.৬৬ গ্রাম
 প্রোটিন৫.৩২ গ্রাম ২.৭ গ্রাম
আঁশ বা ফাইবার৩.১২ গ্রাম০.৮ গ্রাম

একটা সময় ছিল যখন লাল চালের ভাত কেবল নিম্ন আয়ের মানুষের খাবার ছিল। আর এই বাদামী খেয়েই নিম্ন আয়ের সাধারণ লোকজন সুস্থ-স্বাভাবিক এবং বলা চলে নীরোগ জীবন যাপন করতেন। সময়ের পালা বদলে স্বাস্থ্য সচেতনতার অংশ  হিসাবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের অনেকেই এখন খাবার তালিকায় বাদামী চালেরর ভাত যোগ করছেন।

লাল চালের ভাত

লাল চালের ভাত

লাল চাল বা বাদামী চাল কেন উপকারী?

বাদামী চাল কেন উপকারী

বাদামী চাল কেন উপকারী

লাল চালের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট

লাল চালে আছে পর্যাপ্ত অ্যানথোসায়ানিন নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি রক্তে থাকা ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ (ফ্রি রেডিক্যাল) বের করে দেয়। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

এনথোসায়ানিন সূর্যালোকের ক্ষতিকর আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে।  ত্বকের ভাঁজ কমায়, বয়স ধরে রাখে, ত্বককে ক্যানসার ও অন্যান্য রোগ যেমন সোরিয়াসিস থেকে রক্ষা করে।

এনথ্রোসায়ানিন শরীরে প্রদাহ, এলার্জি, ক্যান্সারের ঝুঁকি ও ওজন কমাতে সাহায্য করে।

লাল চালের আঁশ বা ফাইবার

এই চালের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এতে আঁশের পরিমান বেশি। আমরা জানি খাদ্যে আঁশ থাকলে তা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি কোলেস্টেরল কমায়। খাদ্য আঁশ হজমে সাহায্য করে। ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদানগুলোকে অন্ত্রের কোষের সংস্পর্শে বেশিক্ষণ থাকতে দেয় না। পলিশ করা সাদা চাল তৈরির প্রক্রিয়ায় চালের আঁশ প্রায় থাকে না বললেই চলে।

লাল চালে যে সব ভিটামিন আছে

বাদামী চালে ভিটামিন বি১, বি৩, বি৫, বি৬ প্রভৃতি ভিটামিন বেশি মাত্রায় থাকে। শরীরের জন্য এগুলো খুব দরকার। পলিশ করা সাদা চাল তৈরির প্রক্রিয়ায় চালের এসব উপকারী ভিটামিন অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। তাই বাদামী চাল নিঃসন্দেহে সাদা চালের চেয়ে ভালো।

লাল চালে খনিজ পদার্থ

বাদামী চালে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাংগানিজ, ক্যালশিয়াম ও সেলেনিয়াম পাওয়া যায়।

বাদামী চালে প্রাপ্ত ম্যাংগানিজ বিপাকীয় কাজে সাহায্য করে।

ম্যাগনেশিয়াম মাইগ্রেন (মাথাব্যথা) কমায়, রক্তচাপ কমায়, হৃদরোগ প্রতিরোধ করে।

ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম একত্রে হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে, গিরা ব্যথা ও ফোলা এবং হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ করে।

সেলেনিয়াম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সেলেনিয়াম শরীরের গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম ও প্রোটিনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান যা দেহ কোষকে বিভিন্ন ধরনের আঘাত, ক্ষতি ও ইনফেকশনের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়।

লাল চালের উপকারিতা

লাল চালের উপকারিতা

লাল চালের উপকারিতা

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

বাদামী চালের ভাত শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আয়রনের অভাবে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এতে মানুষ দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কাজে মন বসে না। বাদামী চালে আছে আয়রন, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়া বাদামী চাল সেলেনিয়ামের ভালো উৎস। লাল চালের অ্যানথোসায়ানিন নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তের ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ (ফ্রি রেডিক্যাল) বের করে দেয়। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

হাড়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে

হাড় মজবুত করে। বাদামী চালে থাকে ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যলসিয়াম, যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তাই এ চাল খেলে হাড় ক্ষয়ে যাবে না। জয়েন্টের সমস্যাও দূর করবে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন লেভেলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে বাদামী চালের ভাত। এর লো গ্লাইসেমিক সূচক সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এই চাল খুবই উপকারী।

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বাদামী চালে থাকা ফাইবার, পলিফেনল এবং ফাইটিক অ্যাসিড  রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। বাদামী চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাত্র ৫৫ আর সাদা চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭০। তাই বাদামী চালের ভাত খেলে রক্তের গ্লুকোজ লেভেল নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রক্রিয়াজাত সাদা চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি হওয়ায় এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

হজমে সাহায্য করে

বাদামী চালের ফাইবার দেহ থেকে টক্সিন বের করে অন্ত্র ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং পাচনতন্ত্রের কার্যকারীতা বৃদ্ধি করে। খাদ্য সহজে হজম হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও দূর হয় ।

শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধে সহায়তা করে

বাদামী চালে রয়েছে অধিক মাত্রায়  ম্যাগনেশিয়াম, যা দেহের অক্সিজেনের সার্কুলেশন ঠিক রাখতে সাহায্য করে, পালমোনারি ফাংশনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে বাদামী চাল শ্বাসকষ্ট ও এ্যাজমা প্রতিরোধে সাহায্য করে।

ক্যান্সারের আশঙ্কা কমায়

বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই মরণঘাতী রোগ থেকে দূরে থাকতে চাইলে নিয়মিত বাদামী চালের ভাত খাওয়া উচিৎ। বাদামী চালের ভাতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সার থেকে বিশেষ করে কোলন ও ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে।

হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায়

বাদামী চালের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।

ওজন কমায়

 বাড়তি ওজন ও মেদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগলে আপনাকে নিয়মিত বাদামী চালের ভাত খেতে হবে।

কারণ বাদামী চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম বলে এই ভাত খেলে তা শরীরে নানা জায়গায় জমে থাকা চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে। এতে ওজন কমে এবং হৃদযন্ত্র ভাল থাকে।

ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায়

এন্টি অক্সিডেন্ট সূর্যালোকের ক্ষতিকর আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। এটি ত্বকের ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে ও অন্যান্য ত্বকের রোগ যেমন সোরিয়াসিস প্রতিরোধ করে। লাল চালের এনথোসায়ানিন ত্বক মসৃন রাখে এবং বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করে।

রক্তাল্পতায় ওষুধের মত কাজ করে

বাদামী চালের ভাতে আয়রনের পরিমান বেশি থাকায় রক্তাল্পতায় ভোগা মানুষের জন্য এটি ওষুধের মতো কাজ করে।

লাল চালে কি ক্ষতিকর কোন দিক আছে

কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাদামী চালে সামান্য পরিমাণ ক্ষতিকর ফাইটিক এসিড থাকে যা অন্ত্রে আয়রন ও ক্যালশিয়াম শোষণে বাঁধা দেয়। তাই, বাদামী চালের ভাতের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ক্যালশিয়াম ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেলে সেই আয়রন ও ক্যালসিয়াম ঠিক মত শোষিত হয় না। তাই বাদামী চালের ভাত খাওয়ার সময় অধিক আয়রন ও ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।