ব্যয়যোগ্য আয়

মোট জাতীয় উৎপাদন থেকে অবচয় ব্যয়, পরোক্ষ কর, হস্তান্তর পাওনা এবং সরকারের অর্জিত মুনাফা উদ্বৃত্ত বাদ দিয়ে তার সাথে ভর্তুকি যোগ করলে জাতীয় আয় পাওয়া যায়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ( সাধারণত এক বছরে ) একটি দেশের সকল পরিবার ও নাগরিকের আয়ের সমষ্টিকে ব্যক্তিগত আয় বলে। ব্যক্তিগত আয় থেকে কর এবং কর ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিলে অবশিষ্ট যা থাকে তাকে ব্যয়যোগ্য আয় বলে। ব্যয়যোগ্য আয়ের উপর ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। ব্যক্তি স্বাধীনভাবে যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে কিভাবে কতটুকু ভোগের জন্য ব্যয় করবে, কতটুকু সঞ্চয় করবে। এটাই তার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বা স্বাচ্ছন্দ্য।

জাতীয় আয়

National Income, NI

সাধারণত আমরা মনে করি, মোট জাতীয় উৎপাদনের ( GNP ) আর্থিক মূল্যই হচ্ছে জাতীয় আয়। কিন্তু বাস্তবে জাতীয় আয় মোট জাতীয় উৎপাদনের একটি অংশ মাত্র। অর্থাৎ মোট জাতীয় উৎপাদন ( GNP ) থেকে জাতীয় আয় ( NI ) পাওয়া যায়।  GNP থেকে অবচয় ব্যয় (Depreciation Cost) বাদ দিলে  নীট জাতীয় উৎপাদন ( NNP ) পাওয়া যায়। NNP থেকে পরোক্ষ কর, হস্তান্তর পাওনা এবং সরকারের অর্জিত মুনাফা উদ্বৃত্ত বাদ দিয়ে তার সাথে ভর্তুকি যোগ করলে জাতীয় আয় ( NI ) পাওয়া যায়। যেমন –

NI = GNP – Dc – Ti – Tp – Sg + Sb

= NNP – Ti – Tp – Sg + Sb [ যেহেতু, GNP – Dc = NNP ]

যেখানে, NI = National Income,  NNP = Net National Production, Dc = Depreciation Cost (অবচয় ব্যয়),  Ti = Indirect Tax (পরোক্ষ কর), Tp = Transferred Pay (হস্তান্তর  পাওনা), Sg = Government Surplus ( সরকারের অর্জিত মুনাফা উদ্বৃত্ত ), Sb = Subsidy ( ভর্তুকি )।

ব্যক্তিগত আয়

Personal Income, PI

একটি নির্দিষ্ট সময়ে ( সাধারণত এক বছরে ) একটি দেশের সকল পরিবার ও নাগরিকের আয়ের সমষ্টিকে ব্যক্তিগত আয় বলে। তবে ব্যক্তিগত আয় যোগ করলে সত্যিকারের জাতীয় আয় যেমন বের করা যায় না, তেমনি জাতীয় আয় থেকেও সরাসরি ব্যক্তিগত আয় বের করা যায় না। জাতীয় আয় থেকে ব্যক্তিগত আয় বের করতে হলে কিছু সংযোজন বিয়োজন করা দরকার হয়।

হস্তান্তর পাওনা, যেমন- বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, রিলিফ, বেকার বৃদ্ধ বয়সের পেনশন ইত্যাদি জাতীয় আয়ের অন্তর্ভূক্ত নয়। কারণ উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ না করে এই সব আয় পাওয়া যায়। কিন্তু হস্তান্তরজনিত পাওনা ব্যক্তিগত আয়ের অন্তর্ভূক্ত। অন্যদিকে ব্যবসায়ের অবন্টিত মুনাফা ও মূলধনের অবচয়জনিত খরচ কোন ব্যক্তির হাতে আসে না বা ব্যক্তি ব্যবহার করতে পারে না বলে তা ব্যক্তিগত আয়ের অন্তর্ভূক্ত নয়। সুতরাং জাতীয় আয়ের সংগে হস্তান্তর পাওনা যোগ করে তার থেকে ব্যবসায়ের অবন্টিত মুনাফা ও মূলধনের অবচয়জনিত খরচ বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে, তা-ই হল ব্যক্তিগত আয়। সুতরাং ব্যক্তিগত আয়ের ধারণাটি নিম্নরূপে প্রকাশ করা যায় –

PI = NI – ( Tc + Uc + Si ) + ( Tp + In + D )

যেখানে,

PI = Personal Income (ব্যক্তিগত আয়), NI = National income (জাতীয় আয়), Tc = Corporate Tax, Uc = Undistributed Corporate Profit (কর্পোরেশনের অবন্টিত মুনাফা), Si = Social Insurances (সামাজিক নিরাপত্তা বীমার চাঁদা), Tp = Transferred Pay (হস্তান্তর পাওনা), In = Net Interest (সরকার প্রদত্ত নীট সুদ), D = Dividend (কর্পোরেশনের বন্টিত মুনাফা)

ব্যক্তিগত আয়

ব্যক্তিগত আয়

ব্যক্তিগত আয়ের সব টুকু ব্যয় করার স্বাধীনতা মানুষের নেই। যে টুকুর উপর মানুষের স্বাধীনতা আছে তা হল ব্যয়যোগ্য আয়।

ব্যয়যোগ্য আয়

Disposable Income, DI

মানুষ তার আয়ের সমুদয় অর্থ খরচ করতে পারে না। আয়ের একটা অংশ তাকে কর বাবদ এবং কর ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ প্রদান করতে হয়। ব্যক্তিগত আয় থেকে কর এবং কর ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিলে অবশিষ্ট যা থাকে তাকে ব্যয়যোগ্য আয় বলে। অন্যভাবে বলা যায়, ব্যক্তি তার আয়ের যে অংশটি ব্যয়ের জন্য রাখে বা রাখতে পারে তা-ই হল ব্যয়যোগ্য আয়। ব্যয়যোগ্য আয়কে নিম্নোক্ত সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়-

ব্যয়যোগ্য আয়

ব্যয়যোগ্য আয়

DI = PI – T – Oi

DI= Disposable Income (ব্যয়যোগ্য আয়),

PI= Personal Income (ব্যক্তিগত আয়),

T= Direct Tax (প্রত্যক্ষ কর),

Oi = কর ছাড়া অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচ।

কর ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বলতে কর ছাড়া অন্যান্য বাধ্যতামূলক খরচ বুঝায়। যেমন, বিভিন্ন প্রকার লাইসেন্স ফিস, রেজিস্ট্রেশন ফিস, বাধ্যতামূলক চাঁদা ইত্যাদি।

ব্যয়যোগ্য আয়ের সবটা মানুষ ভোগ করে না, কিছু সঞ্চয়ও করে। সুতরাং, প্রত্যেক ব্যক্তির ভোগব্যয় ও সঞ্চয় যোগ করে ব্যয়যোগ্য আয় পাওয়া যায়।

অর্থাৎ,

DI = C + S

যেখানে,

DI = Disposable Income (ব্যয়যোগ্য আয়ে),

C = Consumption Cost (ভোগব্যয়),

S = Savings (সঞ্চয়)।

ব্যয়যোগ্য আয়ের উপর ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। ব্যক্তি স্বাধীনভাবে যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে কিভাবে কতটুকু ভোগের জন্য ব্যয় করবে, কতটুকু সঞ্চয় করবে। এটাই তার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বা স্বাচ্ছন্দ্য।

ব্যয়যোগ্য আয়ের ধারণাটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি, এই ব্যয়যোগ্য আয়ের উপরেই দেশের জনগণের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বা স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে।

অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পেলাম যে, একটি দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান চূড়ান্তভাবে সে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) বা মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) বা নীট জাতীয় উৎপাদন (NNP) বা মোট জাতীয় আয় (GNI) বা নীট জাতীয় আয় (NNI) বা এমন কি ব্যক্তিগত আয় (PI) -এর উপর নির্ভর করে না; নির্ভর করে ব্যয়যোগ্য আয় (DI) -এর উপর।

উপরের সমীকরণগুলি থেকে দেখা যায় যে, ব্যয়যোগ্য আয়ের উপর  পরোক্ষ কর, অবচয় ব্যয়, কর্পোরেট ট্যাক্স, সামাজিক নিরাপত্তা বীমার চাঁদা, সরকারের অর্জিত মুনাফা উদ্বৃত্ত, কর্পোরেশনের অবন্টিত মুনাফা, প্রত্যক্ষ কর এবং  অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচের ঋণাত্মক বা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

পক্ষান্তরে, ভর্তুকি, কর্পোরেশনের বন্টিত মুনাফা, সরকার প্রদত্ত নীট সুদ -এর ধনাত্মক প্রভাব রয়েছে।

সবশেষে বলা যায়, পরোক্ষ কর, অবচয় ব্যয়, কর্পোরেট ট্যাক্স, সামাজিক নিরাপত্তা বীমার চাঁদা, সরকারের অর্জিত মুনাফা উদ্বৃত্ত, কর্পোরেশনের অবন্টিত মুনাফা, প্রত্যক্ষ কর এবং  অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে এবং ভর্তুকি, কর্পোরেশনের বন্টিত মুনাফা, সরকার প্রদত্ত নীট সুদ যথা সম্ভব বাড়িয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যহত রাখতে পারলে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করা সম্ভব। আর এজন্য দরকার দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ও দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

আরও পড়ুন: ভারসাম্য জাতীয় আয়