কর = প্রত্যক্ষ কর + পরোক্ষ কর

কর

কর কাকে বলে?

কর কাকে বলে এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন। কর হল একটি বাধ্যতামূলক আর্থিক মূল্য যা করদাতার উপর সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আরোপিত হয়। কর বা ট্যাক্স শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ট্যাক্সো’ থেকে।  

সর্বসাধারণের কল্যাণে বিভিন্ন ব্যয়ের জন্য সরকারি তহবিল গঠনের দরকার হয়। এই তহবিল গঠনের জন্য সরকার ট্যাক্স আরোপ করে। ট্যাক্স গঠিত হয় প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের সমন্বয়ে।

অধিকাংশ দেশে সর্বসাধারণ/সাধারণ/ স্বীকৃত জাতীয় প্রয়োজন কিংবা সরকারি সমাবেশের জন্য বিভিন্ন স্থানে ট্যাক্স প্রদানের জন্য ট্যাক্স ব্যবস্থা চালু আছে: কোথাও কোথাও করারোপ করা হয় পুরোপুরি একজনের ব্যক্তিগত বার্ষিক আয়ের উপর, কোথাও বার্ষিক জমাকৃত আয়ের উপর ভিত্তি করে এবং কোন কোন দেশে প্রায় করারোপ করা হয় না বললেই চলে কিংবা কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় খুবই অল্প হারে করারোপণ করা হয়।

কোন কোন দেশে সম্মিলিত আয় এবং ব্যক্তিগত লভ্যাংশের উপর করারোপ করা হয় যেটা প্রায় দ্বিগুণ করারোপণের সমান এবং সেখানে স্বতন্ত্র অংশী/অংশীদার বণিকসমিতি থেকে যেই পারিশ্রমিক গ্রহণ করে তাদের ব্যক্তিগত আয়ের উপরেও ট্যাক্স ধার্য করা হয়।

কর কেন বাধ্যতামূলক?

ট্যাক্স কোন স্বেচ্ছা অনুদান নয়। ট্যাক্স প্রদানে ট্যাক্সদাতা বাধ্য। করের হারও নির্ধারণ করে সরকারি কর্তৃপক্ষ। এখানে ট্যাক্সদাতার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন অবকাশ নেই। ট্যাক্স পরিশোধে ব্যর্থ হলে, ছল চাতুরি করলে কিংবা বিরোধিতা করলে তা আইনের দ্বারা শাস্তিযোগ্য।

কর কেন আরোপ করা হয়?

ট্যাক্স সরকারি রাজস্বের একটি প্রধান উৎস, যা দ্বারা দেশের রাজস্ব ও উন্নয়নমূলক ব্যয় নির্বাহ করা হয় এবং যার মাধ্যমে দেশে আয়ের পুনর্বণ্টন, মূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা, ক্ষতিকর ভোগ নিরুৎসাহিত করা হয়। সরকারের নির্বাহী কার্য পরিচালনা ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ, অধিক আয়কারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নিকট থেকে আয়ের একটি অংশ সংগ্রহ করে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে ব্যয়ের মাধ্যমে আয়ের পুনর্বন্টন, বিভিন্ন পণ্য ও সেবার উপর ভিন্ন ভিন্ন হারে ট্যাক্স আরোপ করে মূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা, ক্ষতিকর ভোগ্যপণ্যের উপর তুলনামূলক অধিক ট্যাক্স আরোপ করে ক্ষতিকর ভোগ নিরুৎসাহিত করা ইত্যাদি করের প্রধান উদ্দেশ্য। করের মাধ্যমে বহু আর্থ-সামাজিক উদ্দেশ্য সাধিত হয়।

করারোপ সরকারি অর্থসংস্থানের অন্যান্য উৎস, যেমন টাকার নোট ও মুদ্রা ছাপানো, পণ্যদ্রব্য ও সেবার বিনিময়ে মূল্যগ্রহণ এবং ঋণগ্রহণের অনুপূরক হিসেবে কাজ করে থাকে। অভিধানে ট্যাক্স শব্দের অর্থ হলো রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে আদায়কৃত আর্থিক অবদান। ট্যাক্স কোনো অর্থদন্ড নয়, তবে এ হলো পূর্বনির্ধারিত পদ্ধতিতে বেসরকারি খাত থেকে সরকারি খাতে বাধ্যতামূলক স্থানান্তরিত সম্পদ।

করের আইনগত ভিত্তি কি?

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুসারে, করারোপ বলতে সাধারণ, স্থানীয় বা বিশেষ যে কোনো ট্যাক্স, অভিকর, শুল্ক বা প্রবেশকর-এর আরোপ বোঝায়। অভিকর  স্থানীয় সরকার কর্তৃক আরোপিত হয়, শুল্ক ধার্য করা হয় দ্রব্য বা সেবার ওপর, এবং প্রবেশকর কোনো দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য প্রদেয় ট্যাক্স।

সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সংসদের কোনো আইনের সাহায্য বা কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো ট্যাক্স আরোপ বা সংগ্রহ করা যাবে না। অর্থবিলের মাধ্যমে কোনো করের আরোপ, নিয়ন্ত্রণ, রদবদল, মওকুফ বা রহিতকরণ করা হয়, তবে কোনো ট্যাক্স হ্রাসকরণ বা বিলোপসাধন ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে অর্থবিল রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত সংসদে পেশ করা যায় না।

 জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ কর কর্তৃপক্ষ এবং মোট করের ৯৫% বা মোট রাজস্বের ৭৭% এ বোর্ড আদায় করে থাকে (২০০৯-১০)। মোট করের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-সম্পৃক্ত অংশে রয়েছে  বহিঃশুল্ক,  মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক শুল্ক,  আবগারি শুল্ক, আয়কর, বিদেশ ভ্রমণ ট্যাক্স, বিদ্যুৎ শুল্ক, সম্পদ ট্যাক্স (১৯৯৯-২০০০ থেকে আয়করের সারচার্জ হিসেবে আদায় করা হচ্ছে), টার্নওভার ট্যাক্স, বিমান টিকেট ট্যাক্স,  বিজ্ঞাপন ট্যাক্স, দান ট্যাক্স এবং কতিপয় অন্যান্য অগুরুত্বপূর্ণ ট্যাক্স।

এনবিআর-বহির্ভূত অন্যান্য ট্যাক্স (২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট করের ৫% বা মোট রাজস্বের ৪%)-এর মধ্যে রয়েছে মাদক শুল্ক (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক আদায়কৃত), ভূমি রাজস্ব (ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তহসিল অফিসের মাধ্যমে আদায়কৃত), নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প শুল্ক (অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আদায়কৃত), নিবন্ধন ফিস (আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন পরিদপ্তর কর্তৃক আদায়কৃত), এবং যানবাহন ট্যাক্স (যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আদায়কৃত)।

বাংলাদেশের কর কাঠামোঃ

 প্রত্যক্ষ ট্যাক্স (আয়কর, দান ট্যাক্স, ভূমিউন্নয়ন ট্যাক্স, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, নিবন্ধন, অস্থাবর সম্পত্তি ট্যাক্স, ইত্যাদি) এবং পরোক্ষ ট্যাক্স (বহিঃশুল্ক, মূসক, সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক, বিদেশ ভ্রমণ ট্যাক্স, বিদ্যুৎ শুল্ক, টার্নওভার ট্যাক্স, বিমান টিকেট ট্যাক্স, বিজ্ঞাপন ট্যাক্স, মাদক শুল্ক, যানবাহন ট্যাক্স, ইত্যাদি) নিয়ে গঠিত। সরকারি রাজস্বের কর-বহির্ভূত রাজস্ব হল কর্পোরেশনসমূহের উদ্বৃত্ত, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, রেলওয়ে, ডাক বিভাগ, জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্প, তার ও টেলিফোন ইত্যাদি খাতে আয়।

প্রত্যক্ষ কর

পরোক্ষ কর

 

 

 

 

 

প্রত্যক্ষ কর বনাম পরোক্ষ করঃ

সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য জনসংখ্যার জন্য প্রশাসন ও কল্যাণমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করা, এবং দেশের প্রতিরক্ষার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। ট্যাক্স স্বেচ্ছাসেবী অবদান নয়, বরং মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। প্রত্যক্ষ ট্যাক্স এবং পরোক্ষ কর নামক দুই ধরনের ট্যাক্স আছে, এবং উভয় বিশ্বের সব সরকার দ্বারা অনুপাত বিভিন্ন ব্যবহৃত হয়। যদিও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয় করের আরোপ আদায় করা হয়, তবে তারা প্রকৃতিতে ভিন্ন।

করদাতা ব্যক্তির নিকট থেকে সরাসরি যে ট্যাক্স আদায় করা হয় তাকে বলা হয় প্রত্যক্ষ ট্যাক্স।  প্রত্যক্ষ কর মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত হয় না। সরাসরি করের উদাহরণ হল আয়কর। অন্যদিকে বিক্রয় ট্যাক্স একটি পরোক্ষ ট্যাক্স। এটি বণিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় যারা এটি শেষ গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে।

প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের মধ্যে পার্থক্য কি?

পরোক্ষ করের জন্য পণ্য বা সেবার মূল্য পরিবর্তন হয়। ফলে এটি পণ্যের প্রতি গ্রাহকের পছন্দ পরিবর্তন করে। এইভাবে পরোক্ষ ট্যাক্স  সম্পদ বরাদ্দের উপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। যেখানে সরাসরি করের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোন প্রভাব নেই। অন্য এক পার্থক্য হল সরাসরি করের প্রগতিশীল প্রবণতা যেখানে তারা অসাম্য হ্রাস করে, অথচ পরোক্ষ করগুলি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং আরো অসাম্য সৃষ্টি করে।

প্রত্যক্ষ ট্যাক্স আসে মূলতঃ তুলনামূলক ধনিক শ্রেনির নিকট থেকে। দরিদ্র শ্রেনি মোটামুটি এই করের আওতামুক্ত থাকে। তাই এটি সমাজে অসাম্য দূরীকরণে সাহায়্য করে। কিন্তু ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে পরোক্ষ করের আওতাভুক্ত। তাই পরোক্ষ ট্যাক্স সমাজে অসাম্য বৃদ্ধি করে। 

সরাসরি করের পরিবর্তে পরোক্ষ ট্যাক্স আরোপ করা সহজ।

পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে কোন ছাড় নেই যেখানে অনেকগুলি ডিসকাউন্ট সরাসরি ট্যাক্সে পাওয়া যায়।

সরাসরি করের ক্ষেত্রে সংগ্রহের খরচও কম, যা পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে খুব বেশি।

পরোক্ষ করের প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। অন্যদিকে, সরাসরি ট্যাক্স স্থিতিশীলতা আনতে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে সাহায্য করে।  কারণ তারা জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত ক্রয় ক্ষমতা গ্রহণ করে।

ডাইরেক্ট ট্যাক্স সঞ্চয় কমিয়ে দেয় এবং মানুষ বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয় না যা বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে, পরোক্ষ করগুলি প্রবৃদ্ধি ভিত্তিক। পরোক্ষ ট্যাক্স মানুষকে অতিশয় ব্যয় করা থেকে বিরত রাখে এবং সঞ্চয় উৎসাহিত করে।