জিএনপি ব্যবধান (GNP Gap) = প্রত্যাশিত জিএনপি (Potential GNP) – বাস্তব জিএনপি (Actual GNP )

প্রত্যাশিত জিএনপি  (Potential GNP)

একটি দেশে নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারনত এক বছর) উৎপাদনের উপকরণসমুহ (ভূমি, শ্রম, পুজি ও সংগঠন) যথাযথ দক্ষতায় উৎপাদন কাজে নিয়োজিত করে যে পরিমান চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করা যাবে বলে প্রত্যাশা করা হয় তার আর্থিক মূল্যকে প্রত্যাশিত জিএনপি বা সম্ভাব্য জিএনপি বা অর্জনযোগ্য জিএনপি বা Potential GNP বলা হয়। এটি একটি পূর্বানুমিত প্রাক্কলন যা একটি সম্ভাবনা নির্দেশ করে। আলোচ্য বছরের পূর্ববর্তী বছরে এই প্রাক্কলন (Estimation) করা হয়।

কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে পরিবর্তন দেখা যায়। সব সম্ভাবনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবে রূপায়িত হয় না। কখনও আশাহত হতে হয় আবার কখনও আশাতীত ফল লাভ হয়।

বাস্তব জিএনপি  (Actual GNP)

একটি দেশে নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছর) উৎপাদনের উপকরণসমুহ (ভূমি, শ্রম, পুজি ও সংগঠন)  উৎপাদন কাজে নিয়োজিত করে যে পরিমান চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদিত হয় তার আর্থিক মূল্যকে বাস্তব জিএনপি বা অর্জিত জিএনপি বা Actual GNP বা Real GNP বলা হয়। এটি একটি বাস্তব হিসাব (Calculation)  যা অর্জিত ফলাফল নির্দেশ করে। বছর শেষে এই হিসাব পাওয়া যায়।

জিএনপি ব্যবধান (GNP Gap)

কোন একটি নির্দিষ্ট বছরে একটি দেশের প্রত্যাশিত জিএনপি (Potential GNP) এবং বাস্তব জিএনপি (Actual GNP)-র মধ্যকার ফারাক বা ব্যবধানকে বলা হয় জিএনপি ব্যবধান বা GNP Gap.

জিএনপি ব্যবধান ফর্মুলা

GNP Gap = Potential GNP – Actual GNP.

প্রত্যাশিত জিএনপি এবং বাস্তব জিএনপি যদি সমান হয় তবে জিএনপি ব্যবধান শূন্য হয়। সত্যিকারে এটি কদাচিত দেখা যায়।

অন্যদিকে, বাস্তবে উৎপাদনের উপকরণসমুহ যদি যথাযথ দক্ষতার সাথে উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত না হয় তখন প্রত্যাশিত জিএনপির তুলনায় বাস্তব জিএনপি কম হয়। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মন্দা ও বানিজ্যচক্রের নিম্নগতি দেখা দেয়, বেকারত্ব বেড়ে যায়।

আবার, বাস্তবে উৎপাদনের উপকরণসমুহ যদি পরিপূর্ণ দক্ষতার সাথে উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হয় তখন প্রত্যাশিত জিএনপির তুলনায় বাস্তব জিএনপি বেশি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বানিজ্যচক্রের ঊর্ধগতি পরিলক্ষিত হয়। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

সুতরাং, বলা যায়- প্রত্যাশিত জিএনপির তুলনায় বাস্তব জিএনপি কম হলে অর্থনৈতিক মন্দা ও  বেকারত্ব বেড়ে যায় এবং প্রত্যাশিত জিএনপির তুলনায় বাস্তব জিএনপি বেশি হলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়।

নিম্নে চিত্রের সাহায্যে জিএনপি ব্যবধান ধারণাটি ব্যাখ্যা করা হল –

জিএনপি ব্যবধান

জিএনপি ব্যবধান

চিত্রের OX অক্ষে সময় এবং OY অক্ষে Potential GNP ও Actual GNP ধরা হযেছে। YpYp রেখা Potential GNP এবং YaYa রেখা Actual GNP নির্দেশ করে। এখানে লক্ষণীয় যে, YpYp রেখা  এবং YaYa রেখার ছেদ বিন্যদুতে বা যখন Potential GNP এবং Actual GNP পরস্পর সমান হয় তখন GNP Gap শূন্য (0)। বাস্তবে এ ধরনের অবস্থা খুব একটা দেখা যায় না। যদি Potential GNP এর চেয়ে Actual GNP কম হয় তখন অর্থনীতিতে মন্দা ও বেকারত্ব দেখা দেয় এবং যদি Potential GNP এর চেয়ে Actual GNP বেশি হয় তখন অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

জিএনপি ব্যবধানের কারণ (Causes of GNP Gap)

নানা কারণে জিএনপি ব্যবধানের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটতে পারে। নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হল –

জিএনপি ব্যবধানের হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ

১। প্রাকৃতিক দুর্যোগ – প্রাকৃতিক দুর্যোগে সম্পদের ক্ষয় ক্ষতির এবং পাশাপাশি উৎপাদন বিশেষ করে কৃষি খাতের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার ফলে সামগ্রীক উৎপাদন হ্রাস পায়। এর ফলে জিএনপি গ্যাপ বৃদ্ধি পায়।

২। শ্রমিক অসন্তোষ –  শ্রমিক অসন্তোষের থেকে শ্রমিক আন্দোলন, কর্মবিরতি এমন কি লে-অফ-এর ফলে শিল্পোৎপাদন হ্রাস পায় এবং জিএনপি গ্যাপ বৃদ্ধি পায়।

৩। রাজনৈতিক অস্থিরতা – দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতার  ফলে হরতাল, বন্ধ ইত্যাদির জন্যও সামগ্রীক উৎপাদন হ্রাস পায় এবং ফল স্বরূপ জিএনপি গ্যাপ বৃদ্ধি পায়।

৪। ব্যাংক সুদের হার – সুদের হার বৃদ্ধি পেলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয় ফলে উৎপাদন হ্রাস ও জিএনপি গ্যাপ বৃদ্ধি পায়।

৫। সরকারের আর্থিক প্রণোদনা – সরকারের আর্থিক প্রণোদনার ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ও জিএনপি গ্যাপ হ্রাস পায়।

৬। মহামারি – বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক মহামারির ফলে উৎপাদনের চাকা স্থবির হতে পারে এবং জিএনপি গ্যাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ সাম্প্রতিক কালের বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

৭। প্রযুক্তির উদ্ভাবন – নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে জিএনপি গ্যাপ হ্রাস পায়।

৮। বৈদেশিক বানিজ্যের ভারসাম্য – আমদানি বৃদ্ধি পেলে জিএনপি গ্যাপ বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে জিএনপি গ্যাপ হ্রাস পায়।

৯। অর্থনৈতিক ও আর্থিক সুশাসন – অর্থনৈতিক ও অর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে জিএনপি গ্যাপ হ্রাস পায়।

১০। সঠিক অর্থনৈতিক নীতি – সঠিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হলে জিএনপি গ্যাপ বৃদ্ধি পায়।

১১। সম্পদের দক্ষ ব্যবহার – উৎপাদন উপকরণ ও সম্পদের ব্যবহারে দক্ষতা যত বৃদ্ধি পাবে জিএনপি গ্যাপ তত হ্রাস পাবে।

জিএনপি ব্যবধানের গুরুত্ব (Importance of GNP Gap GNP Gap)

জিএনপি ব্যবধানের ধারণাটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নীতি নির্ধারকদের নিকট নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জিএনপি ব্যবধান ধারণাটি  অবশ্য বিবেচ্য।

১। জিএনপি ব্যবধান ধারণাটির সাথে অর্থনীতির অনেক গুরুত্বপুর্ণ বিষয় জড়িত। যেমন- অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, সামগ্রীক অর্থনৈতিক স্থীতিশীলতা ইত্যাদি। কেননা, জিএনপি ব্যবধান বাড়লে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব দেখা দেয়। অন্যদিকে, জিএনপি ব্যবধান কমতে থাকলে দেশে অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

২। নীতি নির্ধারকদের নিকট বাস্তব জিএনপি, প্রত্যাশিত জিএনপি এবং জিএনপি ব্যবধানের সঠিক তথ্য থাকা জরুরী। কেননা, তা না হলে অর্থনৈতিক মন্দা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে সঠিক নীতি ও কৌশল, আর্থিক নীতি, মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না।

৩। জিএনপি গ্যাপ একটি দেশের অর্থনীতিবিদদের সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করে।

৪। জিএনপি গ্যাপ বানিজ্যচক্র সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে।

৫। জিএনপি গ্যাপ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও উৎপাদনের উপরণসমুহ ব্যবহারে দক্ষতা নির্দেশ করে। জিএনপি ব্যবধান বেশি হলে তা অনেকাংশে সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহারে দক্ষতার ঘাটতির পরিচায়ক। পক্ষান্তরে, এই দক্ষতা যত বৃদ্ধি পাবে জিএনপি গ্যাপ তত কমতে থাকবে। এমন কি উৎপাদনের উপকরণসমুহ যদি পরিপূর্ণ দক্ষতার সাথে উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হয় তাহলে প্রত্যাশিত জিএনপির তুলনায় বাস্তব জিএনপি বেশি হতে পারে।

৬। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সফলতা ও ব্যর্থতা  জিএনপি ব্যবধান থেকে জানা যায়। জিএনপি ব্যবধান বৃদ্ধি পেলে তা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যর্থতা নির্দেশ করে এবং জিএনপি ব্যবধান হ্রাস পেলে তা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সফলতা নির্দেশ করে। আর জিএনপি ব্যবধানের হ্রাস বৃদ্ধি বিবেচনা করে সরকার সে অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারে।