গরুর খনিজ পদার্থের অভাবজনিত  রোগ Mineral Deficiency Diseases in Cattle

প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থের অভাবে গরুর শরীরে যেসব রোগ লক্ষণ দেখা দেয় তাদেরকে গরুর খনিজ পদার্থের অভাবজনিত রোগ বলে।

খনিজ পদার্থের অভাব জনিত  কারনে গৃহপালিত পশুর নানা ধরনের রোগ হয়। ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ঘাটতি সব চেয়ে বেশি দেখা যায়। গরু যে পরিমান ফসফরাস তাদের দেহে  পুনঃসংযোজন করতে পারে উচ্চ উৎপাদনশীল গাভীর দুধের সাথে তার চেয়ে বেশি ফসফরাস বেরিয়ে যায়। ফলে দেহে ফসফরাসের ঘাটতি দেখা দেয়। ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সাহায্য করে এবং হাড়কে শক্ত করে। উচ্চ উৎপাদনশীল গাভীর দুধের সাথে ক্যালসিয়ামও বেরিয়ে যায়।  এই ধরনের উপাদানের অভাবে শরীরে নানা প্রকারের রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।

গরুর খনিজ পদার্থের অভাবজনিত রোগ এর সাধারণ লক্ষণ

  • ফসফরাসের অভাবে পশুর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
  • দুধ উৎপাদন কমে যায়। গর্ভধারণের ক্ষমতা কমে যায়।
  • অস্বাভাবিক খাদ্যোচ্ছা বা পিকা দেখা যায় (পশু অখাদ্য খেতে শুরু করে)।
  • গাভী দুর্বল বাছুরের জন্ম দেয়। জন্মের পরে বাছুরের রিকেট হয়।
  • ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড়ের বৃদ্ধি বন্দ হয়ে যায়।
  • ক্যালসিয়ামের তীব্র  অভাবে গাভীর মিল্ক ফিভার রোগ দেখা দেয়।
  • বাছুরের হাড় বাঁকা হয়ে যায়। বয়স্ক পশুর হাড় নরম হয়ে যায়।
  • সোডিয়াম, পটাসিয়াম, মাগনেসিয়াম, ক্লোরিনের অভাবে পশুতে দুর্বলতা, উসকো খুসকো ত্বক , নরম হাড় ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
  • গরুর উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
  • খনিজ পদার্থের অভাবে গরু সহজেই অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

গরুর খনিজ পদার্থের অভাবজনিত রোগ এর সাধারণ চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

  • পশুকে সব সময় সুষম খাবার দিতে হবে।
  • পশুকে পর্যাপ্ত পরিমানে কাঁচা ঘাস দিতে হবে।
  • হাড়ের গুড়া, লবণ ও অন্যান্য খনিজ মিশ্রন পশুর সম্পূরক দানাদার খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
  • পশুকে ডাইক্যালসিয়াম ফসফেট খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।

 গাভীর দুধ জ্বর বা মিল্ক ফিভার (Milk Fever in Cows)

গরুর খনিজ পদার্থের অভাবজনিত রোগ এর মধ্যে এটি অন্যতম গুরুত্বপুরণ রোগ।

সাধারনত বাচ্চা দেবার তিন দিন আগে হতে তিন দিন পর পর্যন্ত গাভীর মিল্ক ফিভার রোগ হয়ে থাকে। এই রোগে গাভী মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং পক্ষাঘাতগ্রস্থ  রোগের ন্যায় অচেতন হয়ে পড়ে। দুধের মাধ্যমে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম শরীর থেকে বের হয়ে যায়। . ফলে গাভীর শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়। বিপাকীয় রোগের সাথেও মিল্ক ফিভার  দেখা দিতে পারে।

মিল্ক ফিভার রোগের কারণ

  • গাভীর শরীরে পর্যাপ্ত পরিমানে ক্যালসিয়ামের অভাব।
  • খনিজ লবনের বিপাকীয় সমস্যা।
  • শাল দুধের সাথে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যাওয়া।
  • খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব।
  • ভিটামিন ডি এর অভাব।

মিল্ক ফিভার রোগের লক্ষণ

  • প্রথমে ক্ষুধামন্দা দেখা দেয় এবং গাভী কিছুই খেতে চায় না।
  • অস্থিরতা দেখা দেয়।
  • গরু ভয় পাওয়ার মত আচরণ করে।
  • পা এবং মাথা কাঁপতে থাকে।
  • পিছনের পায়ে দুর্বলতা দেখা দেয় এবং শুয়ে পড়ে।
  • বার বার উঠতে চেস্টা করে কিন্তু পিছনের দিক উঠাতে পারে না।
  • মাথা এক দিকে বাকিয়ে পিঠের সাথে ঠেকিয়ে রাখে।

    গরুর খনিজ পদার্থের অভাবজনিত রোগ

    মিল্ক ফিভার এর লক্ষণ

  • ঘাড় শক্ত হয়ে যেতে পারে ফলে মাথা নাড়াতে পারে না।
  • মুখ দিয়ে লালা পড়ে।
  • চোখ সামান্য খোলা রাখে।
  • মুখের ভিতর থেকে জিহ্বা বেরিয়ে আসে।
  • শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়।
  • মাথা এবং পায়ের মাংসপেশি কাঁপতে থাকে।
  • শুয়ে না পড়লেও হাটতে চায় না।
  • পাতলা পায়খানা হতে পারে।
  • মলদ্বারে চিমটি কাটলেও টের পায় না।
  • পেট ফুলে যেতে পারে।
  • মারাত্মক আক্রমনে ১২-২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।

মিল্ক ফিভার রোগের চিকিৎসা ও প্রতিকার

  • লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্র ভেটেরিনারিয়ান দ্বারা চিকিৎসা শুরু করা দরকার।
  • ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস ধীরে ধীরে   শিরার মাধ্যমে দিতে হবে।
  • ভিটামিন এডিই মাংসে ইঞ্জেকশন দিতে হবে।
  • আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • বাচ্চা দেবার বেশ কিছুদিন আগে থেকে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করতে হবে।
  • বাচ্চা দেবার পূর্ব থেকেই দৈনিক ৩০ গ্রাম ক্যাসিয়াম গ্লুকনেট  পানি বা খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।

গ্রাস টিটানি (GRASS TETANY)

এটি গরুর খনিজ পদার্থের অভাবজনিত রোগ এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপুরণ রোগ।

রক্তে মাগনেসিয়ামের অভাবে গ্রাস টিটানি রোগ হয়। এটি গরুর একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং মারাত্মক রোগ। এটি সাধারণত দুগ্ধদানকারী গাভীতে বিশেষ করে যার বাছুরের বয়স ২ মাসের কম এমন গরুতে দেখা দেয়। অল্প বয়স্ক গাভী অপেক্ষা বেশি বয়সের  গাভীতে এই রোগের প্রবনতা বেশি।  তবে এটি অল্প বয়স্ক গাভী, দুগ্ধহীনা গাভী এমন কি বাড়ন্ত বয়সের গরুতেও দেখা যায়। বেশি নরম কচি ঘাস খাওয়ালে এই রোগ হয়। এবং পালের সব চেয়ে ভাল গাভী বেশি আক্রান্ত  হয়।

গ্রাস টিটানি রোগের লক্ষণ

  • প্রথমে চলা ফেরায় অসঙ্গতি দেখা দেয়।
  • পরে খিঁচুনি দেখা দেয়।
  • গরু অজ্ঞান হয়ে যায় ।

    গ্রাস টিটানি

  • শেষে মৃত্যু ঘটে।
  • কোন লক্ষণ দেখা দেবার আগেও মৃত্যু হতে পারে।

গ্রাস টিটানি রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

  • লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্র ভেটেরিনারিয়ান দ্বারা চিকিৎসা শুরু করা দরকার।
  • ঘাসের জমিতে বেশি ইউরিয়া সার দেয়া যাবে না।
  • গরুকে অতি কচি নরম ঘাস দেয়া যাবে না।
  • যে সমস্ত গরু এই রোগে আক্রান্তের প্রবনতা বেশি তাদের প্রতি আলাদা খেয়াল রাখতে হবে।
  • গরুর খাবারের সাথে সম্পুরক ম্যাগনেসিয়াম দেয়া যেতে পারে।

গরুর বিপাকীয় রোগ Metabolic Diseases

শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রাণরাসায়নিক বা বিপাক সংশ্লিষ্ট কার্যাদি সঠিকভাবে সম্পন্ন না হলে যেসব রোগের সৃষ্টি তাকে বিপাকীয় রোগ বলা হয়।  অপুষ্টির কারণে শারীরিক বিপাক পদ্ধতি ভেঙে পড়ে শরীরের অভ্যন্তরীণ কোষের যাবতীয় ভৌত এবং রাসায়নিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় বলেই বিপাকজনিত রোগ সৃষ্টি হয়।

গরুর কীটোসিস রোগ

গরুর কীটোসিস একটি বিপাকীয় রোগ। এটি গরুর একটি মারাত্মক বিপাকীয় রোগ।

এটার অপর নাম এসিটোমিয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া। কিটোসিস রোগে শর্করা এবং স্নেহ জাতীয় খাবারে র হজমে অসুবিধা হয়।

গরুর কীটোসিস রোগের প্রধান কার

হে, খড় বা দানাদার খাবারে যদি শর্করা জাতীর পুস্টি উপাদানের অভাব থাকে তখন গরু শক্তির  জন্য  দেহে সঞ্চিত স্নেহ বা চর্বির  উপর নির্ভরশীল  হয়ে পড়ে।.অতিরিক্ত  চর্বি  ভাঙ্গার ফলে রক্তে ক্ষতিকারক কিটোন বডির আধিক্য দেখা দেয়।  যাতে গরুর দেহে বিষক্রিয়া দেখা দেয়।  এটি  একটি জটিল প্রক্রিয়া । তবে সংক্ষেপে একে কিটোসিস বলে।

গরুর কীটোসিস রোগের লক্ষণ

  • ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়।
  • কাবু ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • দুগ্ধবতী গাভীর দুধ কমে যায়।
  • ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে।
  • চলাচলে অসংগতি দেখা দেয়।
  • মাংস পেশিতে খিচুনি দেখা দিতে পারে।
  • সব সময় কিছু না কিছু চাটতে থাকে।
  • এসিটোনের মিস্টি গন্ধ গরুর নাকে, মুখ, প্রস্রাবে, দুধে এমনকি  পরিবেশেও পাওয়া যায়।
  • দিন দিন শারীরিক ওজন কমতে থাকে।
  • দিশাহীন হাঁটতে থাকে।
  • শক্ত বস্তুর সাথে মাথা ঘসতে থাকে।
  • কখনো কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরতে থাকে।

গরুর কীটোসিস রোগের প্রতিরোধ

  • গর্ভবতী গাভীকে পুস্টিকর খাবার দিতে হবে।
  • উচ্চ দুধ উৎপাদনশীল গাভীকে বাচ্চা দেবার ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৫০ গ্রাম করে প্রপাইলিন গ্লাইগল খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।

গরুর কীটোসিস রোগের চিকিৎসা

  • ১০% গ্লুকোজ সহ ৫০০ সিসি নরমাল স্যালাইন গাভীর শিরায় ইঞ্জেকশন দিতে হবে।
  • ২০০থেকে ২৫০ গ্রান সোডিয়াম বাই কারবোনেট( খাবার সোডা), গ্লুকোজ হাইড্রোকরটিসন পর্যাপ্ত পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পরিমান সহজ পাচ্য শর্করাঅ ও স্নেহ জাতীয় খাবার খাইয়াতে হবে।
  • ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ইঞ্জেকশান দিতে হবে।
  • ভেটেরিনারিই চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করা উত্তম।

*** প্রসঙ্গত সুস্থ ও অসুস্থ গরু চেনার উপায় পড়া যেতে পারে।