অর্থনীতিতে মুদ্রাসংকোচন একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচন একে অপরের সাথে বিপরীত। অর্থনীতিতে এদের ভাল মন্দ উভয়ই থাকে।
এই প্রবন্ধে মুদ্রাসংকোচন কি, কেন হয়, মুদ্রাস্ফীতির সাথে এর পার্থক্য এবং মুদ্রাসংকোচনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
চলুন – শুরু করি…..
Table of Contents
মুদ্রাসংকোচন কাকে বলে?
মুদ্রাসংকোচন (Deflation) হলো মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত অবস্থা। যখন দেশে দ্রব্যসামগ্রীর যোগান অপেক্ষা অর্থের যোগান কম হয় এবং তার ফলে দামস্তর ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে, তখন তাকে মুদ্রাসংকোচন বলে। (অর্থের যোগান বলতে মানুষ যে পরিমান অর্থ পণ্য বা সেবা ক্রয়ের জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত তার সমষ্টিকে বুঝায়)।
আবার বলা যায়, যখন দেশে দ্রব্যসামগ্রীর যোগান অপেক্ষা অর্থের যোগান কম হয়, তখন দামস্তর ক্রমাগত ও অব্যাহতভাবে হ্রাস পেতে থাকে। দামস্তর হ্রাসের এই প্রবনতাই অর্থনীতিতে Deflation হিসেবে বিবেচিত।
অর্থনীতিবিদ পল আইনজিঙ্গের মতে, ‘Deflation এমন একটি অভারসাম্য অবস্থা যেখানে মূল্যস্তরের নিম্নমুখিতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে অর্থনৈতিক শক্তি সংকুচিত হয়ে আসে।’
অধ্যাপক স্যামুয়েলসনের মতে, ‘Deflation বলতে এমন অবস্থা বুঝায় যখন অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য ও উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেতে থাকে।’
সুতরাং বলতে পারি, যখন কোনো দেশে দ্রব্যসামগ্রীর যোগান অপেক্ষা অর্থের যোগান কম হয় এবং দামস্তর ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় তখন তাকে Deflation বা মুদ্রাসংকোচন বলে।
উদাহরণ –
ধরুন, আপনার কাছে ৫০০ টাকা আছে। এই টাকা দিয়ে বছরের প্রথমে আপনি ২৫ কেজি গম কিনতে পারবেন কিন্তু বছর শেষে একই পরিমাণ গম কিনতে আপনার ৫২৫ টাকা লাগবে। এখানে এই ২৫ টাকা আপনার বেশি লাগবে যার মানে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ৫%। যেটা দ্বারা বুঝায় আপনার টাকার ভ্যালু বা মান ৫% কমে গেছে। এটাই মুদ্রাস্ফীতি। এক্ষেত্রে টাকার মান কমে।
আবার, মুদ্রাসংকোচনে টাকার মান বাড়ে। মনে করেন, আগের বছর ২৫ কেজি গমএর দাম ছিল ৫০০ টাকা। এ বছর ২৫ কেজি গমের দাম ৪৭৫ টাকা। তাহলে ২৫ কেজি গম কিনতে আপনার পূর্বের বছরের তুলনায় ২৫ টাকা কম লাগছে। এখানে, ৫% মূল্যসংকোচন হয়েছে। অন্যভাবে বললে আপনি পূর্বের ৫০০ টাকায় এবছর ২৬.৩২ কেজি গম পাচ্ছেন। এটাই মূল্যসংকোচন। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূল্যসংকোচনের ফলে সমপরিমাণ পণ্য কিনেও আপনার হাতে আরো অর্থ থেকে যাবে অথবা সম পরিমান অর্থ দিয়ে আপনি বেশি পরিমান পণ্য কিনতে পারবেন। অর্থাৎ, মূল্যসংকোচন হলে টাকার মান বৃদ্ধি পায়; যা মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত।
মুদ্রাসংকোচন কেন হয়? বা মুদ্রাসংকোচনের কারণ
Deflation হল অর্থের (টাকা) মূল্য বেড়ে যাওয়া আর পণ্যের দাম কমে যাওয়া।
যে যে কারণে Deflation দেখা দিতে পারে –
১. কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলোকে কম পরিমান ঋণ প্রদান করে কিংবা CRR (Cash Reserve Ratio) যদি বাড়িয়ে দেয় তাহলে, মুদ্রাবাজারে অর্থের পরিমাণ কমে যাবে, তখন Deflation সৃষ্টি হয়।
২. পণ্য/সেবার যোগান বেড়ে গেলে: পণ্য বা সেবার যোগান বেড়ে গেলে উৎপাদক বা সরবরাহকারী প্রতিযোগিতার কারণে পূর্বের তুলনায় কম দামে পণ্য বা সেবা বিক্রয় করতে বাধ্য় হয়।
৩. কোন দেশে যদি দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকে কিংবা দূর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বেড়ে যায় তখন ব্যয়যোগ্য অর্থের পরিমান কমে যায়। এ সময়ে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় কমে যায়। ফলে মানুষ পূর্বের তুনায় কম দামে পণ্য বা সেবা ক্রয় করে, বেশি দাম দিয়ে কিনতে চায় না।
উপরের তথ্য গুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে ও ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে Deflation সৃষ্টি হতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রা সংকোচনের মধ্যে পার্থক্য:
সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি বলতে দ্রব্যমূল্যের দীর্ঘকালীন উর্ধ্বগতিকে বোঝায়। উৎপাদন বৃদ্ধি না পেয়ে বা উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় অর্থের যোগান বৃদ্ধি পেলে এরকম হয়। যদি দ্রব্যসামগ্রীর যোগান বৃদ্ধি না পেয়ে অর্থের যোগান বৃদ্ধি পায় তবে অর্থের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অর্থের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার এ রকম প্রবণতাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।
মুদ্রাসংকোচন (Deflation) হলো মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত অবস্থা। যখন দেশে দ্রব্যসামগ্রীর যোগান অপেক্ষা অর্থের যোগান কম হয়; বা অর্থের যোগানের তুলনায় দ্রব্য সামগ্রী বা সেবার যোগান বৃদ্ধি পায় এবং তার ফলে দামস্তর ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে, তখন তাকে মুদ্রাসংকোচন বলে বা দামস্তর হ্রাসের এই প্রবণতাই অর্থনীতিতে Deflation হিসেবে বিবেচিত।
ক্রমিক নং | মুদ্রাস্ফীতি | মুদ্রাসংকোচন |
১ | বাজারে পণ্য ও সেবার যোগান অপেক্ষা অর্থের যোগান বৃদ্ধি পায়। | বাজারে পণ্য ও সেবার যোগান অপেক্ষা অর্থের যোগান কম থাকে। |
২ | পন্য ও সেবার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। | পন্য ও সেবার চাহিদা হ্রাস পায়। |
৩ | উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। | উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়। |
৪ | পন্য ও সেবার মূল্য বাড়ে। | পন্য ও সেবার মূল্য কমে। |
৫ | অর্থের ক্রয় ক্ষমতা বা বিনিময় মূল্য কমে যায়। | অর্থের ক্রয় ক্ষমতা বা বিনিময় মূল্য বেড়ে যায়। |
৬ | মজুরি ও আয় বাড়ে। | মজুরি ও আয় কমে। |
৭ | মুনাফা বৃদ্ধি পায়। | মুনাফা হ্রাস পায়। |
৮ | উৎপাদন বৃদ্ধির প্রবনতা সৃষ্টি হয়। | উৎপাদন হ্রাসের প্রবনতা সৃষ্টি হয়। |
৯ | নতুন উদ্যোগ ও বিনিয়োগ বাড়ে। | লে-অফ বাড়ে, বিনিয়োগ কমে। |
১০ | কর্মসংস্থান বাড়ে। বেকারত্ব হ্রাস পায়। | কর্মী ছাটাই ও বেকারত্ব বাড়ে। |
১১ | অর্থের গতিশীলতা বাড়ে। | অলস অর্থ বাড়ে। |
১২ | ঋণ পরিশোধের প্রবনতা বাড়ে। | ঋণ খেলাপী বাড়ে। |
১৩ | রপ্তানি বানিজ্য উৎসাহিত হয়। | রপ্তানি বানিজ্য নিরুৎসাহিত হয়। |
১৪ | কাঙ্খিত মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি কোন দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। | মুদ্রাসংকোচন কোন দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা আনে। |
মুদ্রা সংকোচন কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে?
মুদ্রাসংকোচনের ফলে পণ্য ও সেবার মূল্য কমে যাওয়ায় বাজারে অর্থ প্রবাহ হ্রাস পায় এবং কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে যায়। এর ফলে উৎপাদন হ্রাসের প্রবনতা সৃষ্টি হয়। কোম্পানি লে-অফ ঘোষনা করে অথবা উৎপাদন ইউনিট কমিয়ে দেয়। নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। এতে করে নতুন নিয়োগ বন্ধের পাশাপাশি কর্মচারি ছাটাই করা প্রয়োজন হয়। ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।
মানুষের আয় কমে যাওয়ায় পণ্য ও সেবা ক্রয়ের চাহিদা কমে যায়। ফলে বাজারে পণ্য ও সেবার উদ্বৃত্ত যোগান বা সরবরাহ পরিলক্ষিত হয়।
বাজারে অর্থের যোগানের তুলনায় পণ্য ও সেবার যোগান বা সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্য ও সেবার মূল্য কমে যায় অর্থাৎ মুদ্রাসংকোচন সৃষ্টি হয়। এই ক্রমাগত মুদ্রাসংকোচন নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (CRR) কমিয়ে দিয়ে বাজারে অধিক অর্থ সরবরাহের নীতি গ্রহণ করতে হয়।
সরকার বেকার সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন প্রণোদনা, ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন প্রতিষ্ঠান চালু রাখার চেষ্টা করে এবং জনগনের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকার সেফটিনেট (সামাজিক সুরক্ষা) কার্যক্রম গ্রহণ করে।
এছাড়াও সরকার অনেক সময় নোট ছাপিয়ে বাজারে অর্থের যোগান বৃদ্ধি করে থাকে।
Hello valued readers, please post your comments.
Regads
Very good post 😌
ধন্যবাদ। শুভ কামনা
[…] […]