অর্থনীতির নীতি

অর্থনীতির ১০টি নীতি

এই প্রবন্ধে অর্থনীতির নীতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতির যেসব নীতি উল্লেখ করেছেন সেগুলি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থনীতির নীতি সব আমরা সাধারন মানুষ জানি না। তবে না জেনেও অনেকগুলি পালন করি। 

অর্থনীতির নীতি কয়টি? অর্থনীতির নীতি ১০টি। যথা- বিকল্প বাছাই, সুযোগ ব্যয়, প্রান্তিক ব্যয় ও প্রান্তিক সুবিধা, প্রণোদনায় সাড়া দেয়া, বানিজ্য সম্পর্ক, বাজার ব্যবস্থা, সরকারী হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা, মানুষের জীবন যাত্রার মান, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের মধ্যে বিনিময় (trade off) সম্পর্ক। 

নিচে এগুলি আলোচনা করা হল।

অর্থনীতির নীতিঃ 

বিকল্প বাছাইঃ

সমাজে যেসব দ্রব্য ও সেবা পাওয়া যায় মানুষ তা আদান-প্রদান করে। মানুষের প্রয়োজন বা অভাব অসীম। কিন্তু অভাব পূরণের জন্য যে সব দ্রব্য বা সেবা পাওয়া যায় তার পরিমান সীমিত। অর্থাৎ প্রত্যেকের ভোগ চাহিদা পূরণ করার মত দ্রব্য বা সেবার পরিমান পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে সমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়  সীমিত সম্পদ কিভাবে ব্যবহৃত হবে বা সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে কিভাবে এই সম্পদ বন্টন করা হবে। এক্ষেত্রে পছন্দের কোন একটি জিনিস পাওয়ার জন্য  অপর আরেকটি পছন্দের জিনিস ছেড়ে দিতে হয়।

মানুষের অভাব পূরণে সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতার জন্য বিভিন্ন অভাবের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ অভাবটি বাছাই করে মানুষ তা পূরণ করে। এটি ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোন রাষ্ট্র যদি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বেশি করে তাহলে সেই দেশের জনগনের জীবিকা নির্বাহে ব্যয় কমাবে। এভাবে মানুষ সমাজে আদান-প্রদানের (trade off) মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা বাছাই করে।  তাই বিকল্প বাছাই অর্থনীতির নীতি সমুহের মধ্যে অন্যকম প্রধান। 

সুযোগ ব্যয়ঃ

অর্থনীতির নীতি সমুহের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। সম্পদের সীমাবদ্ধতার জন্য মানুষকে তার পছন্দের জিনিসের মধ্যে বাছাই করতে হয়। একটি সুযোগ গ্রহণ করলে অপর একটি সুযোগ তাকে ছেড়ে দিতে হয়। মানুষ যে দ্রব্য বা সেবা ছেড়ে দেয় তার সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। আবার যে দ্রব্য বা সেবা ভোগ করে তার সুবিধা প্রাপ্ত হয়। যদি কেউ চাকুরি করে তাহলে সে সময় সে ব্যবসা করা থেকে বিরত থাকে বা থাকতে হয়। এক্ষেত্রে তার জন্য ব্যবসা হচ্ছে চাকুরির সুযোগ ব্যয়।

প্রান্তিক ব্যয়প্রান্তিক সুবিধাঃ

অর্থনীতির নীতি সমুহের মধ্যে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি চলমান প্রক্রিয়ায় অল্প অল্প পরিবর্তন হয়ে থাকে। এই অল্প পরিবর্তনকে বলে প্রান্তিক পরিবর্তন। প্রান্তিক পরিবর্তন করতে গিয়ে যে ব্যয় হয় তাকে বলে প্রান্তিক  ব্যয়। আবার এই প্রান্তিক পরিবর্তনের ফলে যে সুবিধা সৃষ্টি হয় তাকে বলে প্রান্তিক সুবিধা। যেমন – এক জন কৃষক তার ক্ষেতে অতিরিক্ত ‘ক’ জন শ্রমিক  নিয়োজিত করে অতিরিক্ত ‘খ’ একক উৎপাদন পেল। তাহলে অতিরিক্ত ‘খ’ একক উৎপাদনের সুবিধা পেতে তাকে ‘ক’ একক শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রান্তিক খরচ = (ক একক শ্রমিকের মজুরি ÷ খ) [ প্রান্তিক খরচ = শেষ এক একক উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত  উপকরনের খরচ]

আবার, প্রান্তিক সুবিধা = (খ একক ফসলের দাম ÷ ক)। [প্রান্তিক সুবিধা = শেষ এক একক উপকরণ প্রয়োগে প্রাপ্ত সুবিধা]। যুক্তিবাদী মানুষ সব সময় প্রান্তিক খরচের চেয়ে বেশি প্রান্তিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্র বিবেচনা করে।

প্রণোদনায় সাড়া দেয়াঃ

মানুষের ব্যবহারে তখনই পরিবর্তন ঘটে যখন খরচ বা সুবিধা সংক্রান্ত কোন পরিবর্তন ঘটে।  অর্থাৎ মানুষ উদ্দীপনা বা অনুপ্রেরণায় সাড়া দেয়। যেমন- চালের দাম বেড়ে গেলে মানুষ ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়ে আটা খাওয়া বাড়িয়ে দেয়। কোন জুতা কোম্পানি দামের উপর ছাড় দিলে মানুষ অন্য কোম্পানির জুতা অপেক্ষা মূল্য ছাড় কোম্পানির জুতা বেশি কিনবে। অফার থাকলে মানুষ একসাথে বেশি পরিমানে পণ্য কিনে। বোনাস পেলে শ্রমিকরা কাজে অধিক উৎসাহী হয়। অর্থনীতির নীতি সমুহের মধ্যে এটি এ জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে যে, সাধারণ মানুষ এটি না জেনেই মেনে চলেন।

বানিজ্য সম্পর্কঃ

ব্যবসা বা বানিজ্য না থাকলে কি হত? প্রতিটি পরিবারকে তার অভাব পূরণের জন্য যা কিছু দরকার সব নিজেদেরকেই উৎপাদন বা তৈরি করতে হত – খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিক্ষা, আরাম দ্রব্য, বিলাস দ্রব্য ইত্যাদি। কিন্তু তা কি সম্ভব হত? এজন্য যে যা উৎপাদনে সক্ষম সে তার নিজের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি উৎপাদন করে। যার যা প্রয়োজন নাই সে তাও উৎপাদন করে। পরে যার যা প্রয়োজন সে সেটা অন্যের কাছ থেকে কিনে নেয়। প্রতিটি পরিবারকে সমাজের অন্যান্য পরিবারের উপর নির্ভর করতে হয়। অর্থাৎ সমাজে ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানসমুহের মধ্যে বানিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। এতে সবাই উপকৃত হয়। পরিবারের মত বিভিন্ন দেশের মধ্যে তাদের উৎপাদিত বিশেষায়িত দ্রব্য বানিজ্যে প্রতিটি দেশই লাভবান হয়।

বাজার ব্যবস্থাঃ

 অর্থনৈতিক কার্যাবলী সংগঠিত করার জন্য বাজার ব্যবস্থা একটি উত্তম উপায়৷ বাজার ব্যবস্থায় ফার্মসমুহ বা পরিবারবর্গের স্বাধীনতা থাকে কোথায় বিনিয়োগ করবে,  কি উৎপাদন করবে, কোথায় উৎপাদন করবে,  কি দামে বিক্রয় করবে এধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার। এখানে দ্রব্য বা সেবার দাম বাজারের চাহিদা ও যোগানের উপর নির্ধারিত হয় এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। চাহিদা বৃদ্ধি পেলে দাম ও যোগান বৃদ্ধি পায়, যোগান বৃদ্ধি পেলে দাম কমে ও চাহিদা বৃদ্ধি পায়, দাম বৃদ্ধি পেলে চাহিদা কমে ও যোগান বৃদ্ধি পায়। 

সরকারী হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাঃ 

অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ তার বিখ্যাত গ্রন্থ Wealth of Nation এ বলেছেন বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় অদৃশ্য হাত দ্বারা। তবে বাজার ব্যবস্থার অদৃশ্য হাত অনেক সময় মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। তখন সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে। সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ রোধ, দুর্নীতি দমন, আয়কর, কল্যাণ ব্যবস্থা ইত্যাদিতে সরকারি নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক কল্যানের সুষম বন্টন হয়ে থাকে। 

মানুষের জীবন যাত্রার মানঃ

প্রতিটি দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান নির্ভর করে সে দেশের উৎপাদন ক্ষমতার উপর। যে দেশের দ্রব্য বা সেবা উৎপাদনের ক্ষমতা বেশি সে দেশের মানুষের উন্নত খাবার ব্যবস্থা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও নাগরিক সুবিধা বেশি এবং জীবন যাত্রার মান ও উন্নত। অন্যদিকে কম উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দেশে মানুষের জীবন যাত্রার মান অনুন্নত। আর এই উৎপাদন ক্ষমতা নির্ভর করে উন্নত যন্ত্রপাতি, উন্নত প্রযুক্তি, শ্রমিকের দক্ষতা, ব্যবস্থাপনার দক্ষতার উপর।

মুদ্রাস্ফীতিঃ

সরকার যখন অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপায় তখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতিতে যখন দামস্তর বৃদ্ধি পায় তখন সেখানে মূল্যস্ফীতি বা মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে অর্থের যোগান বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। আর এই অর্থের যোগান বৃদ্ধি করে যে কোন দেশের সরকার। মুদ্রাস্ফীতিতে অর্থের  মূল্য বা মান কমে যায়। মূল্যস্ফীতির পূর্বে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থে যে পরিমান পণ্য বা সেবা পাওয়া যায় মূল্যস্ফীতি ঘটলে সেই একই পরিমান অর্থ দিয়ে তার থেকে কম পরিমান পণ্য বা সেবা পাওয়া যায়।

মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের মধ্যে বিনিময় (trade off) সম্পর্কঃ

সমাজে স্বল্প মেয়াদে মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের মধ্যে বিনিময় (trade off) সম্পর্ক বিদ্যমান। স্বল্প মেয়াদে যখন দামস্তর বৃদ্ধি পায় তখন ফার্মসমুহ তাদের উৎপাদিত পণ্য বা সেবার যোগান বাড়াতে চায়। এ কারণে ফার্মসমুহে অতিরিক্ত দ্রব্য বা সেবা উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগের প্রয়োজন হয় যা বেকারত্ব হ্রাস করে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি হলে বেকারত্ব কমে এবং মূদ্রা সংকোচনে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। মূ্ল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অনেক সময় স্বল্পকালীন বেকারত্ব দেখা দেয়। কারণ সরকার তখন মুদ্রা সংকোচন নীতি অনুসরণ করে এবং ফার্ম সমুহ উৎপাদন কমিয়ে দেয়। মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের এই সম্পর্ক বা বিনিময় স্বল্প সময়ের জন্য প্রযোজ্য। এজন্য বর্ধিঞ্চু অর্থনীতিতে নির্দিষ্ট মাত্রার মূল্যস্ফীতি (৫-৬%) কাম্য। 

উপসংহারে   বলা যায় অর্থনীতির নীতি সম্পর্কে আমরা না জেনেই এদের অনেকগুলি পালন করে থাকি। তবে সফল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থনীতির নীতি সমুহ জানা ও পালন করা প্রয়োজন।