আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য ভীতি (foods scares) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
এটিকে পাঁচটি বিভাগে আলোচনা করা যায়।
- কেন খাদ্য ভীতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠেছে?
- খাদ্য ভীতির সংজ্ঞা।
- খাদ্য ভীতির প্রকারভেদ বা টাইপোলজি।
- খাদ্য ভীতি দ্বারা নির্ধারিত ভোক্তাদের আচরণের পরিবর্তন।
- রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্থার সংশ্লেষ।
Table of Contents
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য ভীতির গুরুত্ব
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কৃষি থেকে যে ব্যবস্থায় খাদ্য খুচরা বিক্রেতা এবং পরিষেবাতে যায় তা আরও বেশি বৈশ্বিক (global) এবং জটিল (complex) হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান এবং বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যাকে সন্তুষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা, জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ু দূষণ, জল দূষণ, বৈশ্বিক বর্জ্য, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কথা চিন্তা করুন। এই শক্তিগুলি কৃষি অনুশীলন (agricultural practices), উৎপাদন (production), সংরক্ষণ (storage), খুচরা বিক্রয় (retailing) এবং সরবরাহের (delivery) উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
খাদ্য সেক্টর এখন একটি বৈশ্বিক বাজারে (global market ) পরিণত হয়েছে, যেখানে সারা বিশ্ব থেকে পণ্য আসে, যাতে ঋতু ভেদে স্বাধীন বৈচিত্র্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো যায়।
উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, ইতালিতে বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যযুক্ত অনেক ধরণের স্থানীয় চেরি রয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা সারা বছর ধরে তুরস্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, চিলি এবং আর্জেন্টিনা থেকে আসা চেরি খাচ্ছে।
আপনি কল্পনা করতে পারেন, এই চেরিগুলি ট্রাক, জাহাজ, প্রতিনিধি ট্রাক (delegate trucks ) বা রেলপথে হাজার হাজার দিন দিন ভ্রমণ করছে।
এই বিবর্তনের ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল আরও জটিল হয়। এতে অনেক এ্যাক্টর জড়িত থাকে যারা একে অপরের প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি (processes and procedures) সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখে না বা রাখতে পারে না।
বার্গার কিং এর একটি হ্যামবার্গারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সারা বিশ্বের আনুমানিক ২০০ সরবরাহকারীর উপাদান থাকতে পারে।
ফলস্বরূপ, সরবরাহ শৃঙ্খলের এক পর্যায়ে যখন সমস্যা দেখা দেয় তখন তার সঠিক কারণটি এমনকি মূল কেন্দ্রস্থল সনাক্ত করা সহজ হয় না।
তাই, খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি, বাস্তব হোক বা গুজব হোক, খাদ্য ভীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে খাদ্য বিষয়ে ভোক্তাদের উদ্বেগ বাড়ছে।
খাদ্য ভীতির সংজ্ঞা
২০০৪ সালে সুজান ফ্রেডবার্গের (Susanne Freidberg) লেখা একটি বইয়ের শিরোনাম ‘চিন্তিত যুগে সংস্কৃতি ও বাণিজ্য’ (Culture and commerce in an anxious age’)। বইটির দ্বিতীয় অংশে ‘খাদ্য ভীতি’ (‘food scare’) শব্দটি বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহৃত হযয়েছে। এটি প্রায়শই ‘খাদ্য বিপদ’ (‘food hazard), ‘খাদ্য ঘটনা’ (‘food incidents’), ‘খাদ্য ভয়’ (‘food fear’) এর মতো অভিব্যক্তির সাথে যুক্ত হয়েছে।
খাদ্য ভীতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে একটি বাস্তব বা অনুভূত খাদ্য ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে, যা খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল এবং খাদ্য গ্রহণের ধরণগুলির আকস্মিক ব্যাঘাত ঘটায়।
আরেকটি সংকীর্ণ সংজ্ঞা হল খাদ্যজনিত অসুস্থতার একটি নিশ্চিত প্রাদুর্ভাব, যা ভোক্তাদের চাহিদা একটি চিহ্নিত এবং তুলনামূলকভাবে আকস্মিক পতনের দিকে পরিচালিত করে।
উভয় সংজ্ঞার মধ্যে, ভোক্তা আচরণের আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল খাদ্য ভীতি এমন একটি ঘটনা যা পরিবর্তিত ভোক্তা আচরণে নিজেকে প্রকাশ করে। এই ঘটনার কারণ একটি খাদ্যজনিত অসুস্থতা হতে পারে। তবে সরবরাহ শৃঙ্খলে পণ্য বা উপাদানের অননুমোদিত উপস্থিতির কারণে ভয় দেখা দিয়েছে।
সমস্যাটি সম্ভবত একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং একটি নৈতিক সমস্যা (ethical or moral issue)।
যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল একবার সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন চূড়ান্ত ভোক্তা যে খাবারের প্রতি উদ্বেগ বোধ করে, সেই খাদ্য সরবরাহকারীর খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং এটি কেনা এবং খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এতে বাজারের চাহিদার উপর নাটকীয় প্রভাব পড়ে। যার ফলে সমস্ত এ্য়াক্টর সতন্ত্রভাবে অপরাধবোধে ভুগতে থাকে।
এটি চূড়ান্ত ভোক্তার প্রতিক্রিয়া যা সরবরাহ শৃঙ্খলে যে কোনও সময়ে ঘটতে থাকা একটি ঘটনাকে খাদ্য ভীতির দিকে ধাবিত করে এবং এই প্রতিক্রিয়ার ফলে ভোক্তাদের খাওয়ার অভ্যাস এবং ধরণগুলিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।
খাদ্য ভীতির প্রকারভেদ বা টাইপোলজি
২০১৭ সালে ব্রিটিশ ফুড জার্নাল খাবারের ভয়ের ব্যাপক শ্রেণীবিভাগের উপর একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এখানে তিন জন লেখক খাদ্যের ভয়ের একটি শ্রেণীবিভাগ তৈরি করেছেন। যা পাঁচটি প্রধান প্রকারে সংগঠিত।
তথ্য:
ভোক্তাদের জন্য একটি খাদ্য আইটেম উৎপাদনে ব্যবহার করা উপাদান এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তথ্যের বিধান উল্লেখ করে। সঠিক তথ্যের ঘাটতি ও মিথ্যা তথ্য ভোক্তার নিকট কোন খাদ্য সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করতে পারে।
প্রযুক্তি বা শিল্প প্রক্রিয়াকরণ (Technology or industrial processing):
যা প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায় যার ফলাফল হতে পারে হয় অনিরাপদ খাদ্য আইটেম বা জনসাধারণের দ্বারা ক্ষতিকারক বলে মনে করা খাদ্য আইটেম। উদাহরণ হল প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ (technological interventions), যেমন জেনেটিক পরিবর্তন এবং বিকিরণ (genetic modification and irradiation)।
মাইক্রোবায়োলজিক্যাল (Microbiologica):
সেই সব অণুজীবের দ্বারা খাদ্য সামগ্রীর দূষণকে বুঝায় যাদেরকে বাতাস, খাদ্য, জল, মাটি, প্রাণী এবং মানুষের শরীরে পাওয়া যায়। যেমন সালমোনেলা জীবানু দ্বারা সংক্রমিত খাদ্য, নিপা ভাইরাস সংক্রমন, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি।
দূষিত পদার্থ (Contaminants):
স্বাভাবিকভাবে খাদ্য আইটেমে পাওয়া যায় না এমন পদার্থ দ্বারা খাদ্য আইটেমের দূষণ সম্পর্কিত সমস্ত ভীতি বুঝায়। এটি জৈবিক, রাসায়নিক বা বস্তুগত (biological, chemical or physical) হতে পারে।
উদাহরণ, খাদ্যে ভারী ধাতুর উপস্থিতি। যেমন সীসা, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি, অননুমোদিত বা মাত্রারিক্ত এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি।
প্রতারণা (Deception):
যা প্রতারণামূলক প্রতিস্থাপন (fraudulent substitution), খাদ্য সামগ্রীতে উপাদানের যোগ বা বিয়োগকে কভার করে। যেমন, মিথ্যা ঘোষনা, ভেজাল মিশানো, ঘোষিত উপাদান বা তার পরিমানের ঘাটতি ইত্যাদি।
পাঁচটি বিভাগ পারস্পরিকভাবে একচেটিয়া (mutually exclusive) নয় কারণ কিছু ধরণের ভয় রয়েছে যা দুটি বিভাগের মধ্যে একটি ধূসর এলাকার মধ্যে পড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালের ঘোড়ার মাংস কেলেঙ্কারির ঘটনা, যেখানে গরুর মাংস থাকার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া খাবারগুলিতে অঘোষিত (undeclared ) বা অনুপযুক্তভাবে ঘোষিত (improperly declared) ঘোড়ার মাংস পাওয়া গেছে। কিছু ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ঘোড়ার মাংস পাওয়া গেছে।
খাদ্য ভীতি দ্বারা নির্ধারিত ভোক্তাদের আচরণের পরিবর্তন
সোশ্যাল মিডিয়া যা একটি ঘটনাকে খাবারের ভয়ে রূপান্তরিত করতে পারে এবং বছরের পর বছর ধরে বিতর্ককে উসকে দিতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের যোগাযোগ, মূল্যায়ন এবং তথ্য শেয়ার করার উপায় পরিবর্তন করেছে, এক্সপোজার এবং পুনরাবৃত্তির সংখ্যা বাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী আন্তঃসংযোগ (global interconnectedness) সংবাদের নাগাল প্রসারিত করে, যা সহজেই ভয়ের কারণ হতে পারে। এই ভয় একটা সিরিজ তৈরি করে ভোক্তাদের আচরণের পরিবর্তন করতে পারে। যা লোকেদের পণ্য কেনা বন্ধ করা হতে পারে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে গরুর দুধে অননুমোদিত এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি সংক্রান্ত যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা বা অসমর্থিত একটি তথাকথিত গবেষণার অবিবেচনা প্রসূত মিডিয়া প্রচারে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য পণ্য সম্পর্কে ব্যাপক ভীতি সঞ্চারিত হয় এবং বাজারে দুধের চাহিদা ও দাম সাঙ্ঘাতিকভাবে কমে যায়।
পছন্দকে সমর্থন করার জন্য সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য দাবি করা থেকে, ভয়ের জন্য দায়ী নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডকে নিষিদ্ধ করা পর্যন্ত। পণ্যের বাজারের চাহিদা হঠাৎ করে কমে যাওয়ার ফলে পরিণতি গুরুতর হতে পারে। এমনকি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড বা পণ্যের প্রবণতা সহজে বিপরীত হতে পারে।
বিপণনের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হতে পারে নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্যায়নের মানদণ্ডে পরিবর্তন।
এখন ভোক্তারা সাপ্লাই চেইনের স্বচ্ছতা দাবি করে, তারা পণ্যের উৎপত্তি দেশ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য চায়, এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো যাত্রার সম্পূর্ণ ট্রেসেবিলিটি গ্যারান্টি দিতে সক্ষম কোম্পানিকে পুরষ্কৃত করে।
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্থার সংশ্লেষ
খাদ্য ব্যবস্থায় জড়িত সমস্ত স্টেকহোল্ডারদেরও উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব রয়েছে।
এর বর্ধিত জটিলতা এবং বিশ্বায়ন, প্রজাপতির প্রভাবের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে, যেখানে একটি তুচ্ছ ঘটনা একটি প্রজাপতির অনুপযুক্ত ব্যবস্থাপনা খুব বড় পরিসরে প্রভাব ফেলতে পারে।
খাদ্য ব্যবস্থার সাথে জড়িত সমস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্থাগুলিকে এমন কৌশল গ্রহণ করা উচিত যা ঘটনার সংখ্যা এবং তাদের সম্পর্কিত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাব উভয়ই হ্রাস করে।
ধ্রুবক বিবেচনায় (constant consideration) রাখার জন্য কয়েকটি মূল বিষয় হল
- খাদ্যের মান পর্যালোচনা করা (Reviewing food standards),
- নিয়ম প্রয়োগ করা (enforcing the rules),
- সিস্টেমের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা (augmenting the control of all the operations of the system),
- যোগাযোগ কার্যকরভাবে পরিচালনা করা (managing the communication effectively),
- দায়িত্বশীল আচরণকে পুরস্কৃত করা (rewarding responsible behavior ) এবং
- অনুপযুক্ত আচরণ নিষিদ্ধ করা (banning improper behavior )।
Leave A Comment