ভোক্তার উদ্বৃত্ত কি?

Consumer’s Surplus

কোন ব্যক্তি যখন কোন দ্রব্যের জন্য বেশি দাম দিতে ইচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত কম দামে তা ক্রয় করতে পারে তখন সে যে বাড়তি সুবিধা (উদ্বৃত্ত উপযোগ) ভোগ করে তাকে ঐ ভোক্তার উদ্বৃত্ত বলা হয়। ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটির প্রবক্তা অধ্যাপক মার্শাল।

মনে করি আমাদের আজিম বাজারে গেল ইলিশ মাছ কিনতে। সে মনে করেছিল ১০০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ মাছ কিনবে। বাজারে গিয়ে দেখল তার কাঙ্খিত সাইজের ইলিশ ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সে ৯০০ টাকা করে মাছ কিনল। এখানে ভোক্তা হিসাবে তার উদ্বৃত্ত সন্তুষ্টি (১০০০ টাকা – ৯০০ টাকা = ১০০ টাকা) ১০০ টাকা।

একটি দ্রব্যের জন্য ভোক্তা যে দাম দিতে ইচ্ছুক তাকে ব্যক্তিগত চাহিদা দাম এবং প্রকৃতপক্ষে সে যে দাম দিয়ে ক্রয় করে তাকে বাজার দাম বলে। উপরের উদাহরণে ব্যক্তিগত চাহিদা দাম ১০০০ টাকা, আর বাজার দাম ৯০০ টকা।)

ব্যক্তিগত চাহিদা দাম ও বাজার দামের মধ্যে ইতিবাচক ব্যবধান হলো ভোক্তার উদ্বৃত্ত। উদাহরণের আজিমের ক্ষেত্রে ভোক্তার উদ্বৃত্ত হলো (১০০০ টাকা – ৯০০ টাকা) = ১০০ টাকা।

দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ তার দামের সমান হয় বলে চাহিদা দামগুলির সমষ্টি তার প্রান্তিক উপযোগগুলির সমষ্টি অর্থাৎ মোট উপযোগ প্রকাশ করে। তাই ভোক্তার উদ্বৃত্ত নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা যায় –

ভোক্তার উদ্বৃত্ত = মোট উপযোগ – দাম x ক্রীত দ্রব্যের সংখ্যা বা পরিমান।

তালিকার সাহায্যে ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণার  ব্যাখ্যা

নিম্নে ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটি তালিকার সাহায্যে দেখানো হলো –

ইলিশের পরিমান

চাহিদা দাম (প্রান্তিক উপযোগ)

বাজার দাম

ভোক্তার উদ্বৃত্ত

১ম ১ কেজি

১১০০ টাকা৯০০ টাকা২০০ টাকা

২য় ১ কেজি

১০০০ টাকা

৯০০ টাকা

১০০ টাকা

৩য় ১ কেজি

৯০০ টাকা

৯০০ টাকা

০ টাকা

মোট ক্রয় ৩ কেজিমোট উপযোগ ৩০০০ টাকামোট দাম ৯০০ টাকা

ভোক্তার মোট উদ্বৃত্ত ৩০০ টাকা

 

উপরের তালিকায় দেখা যায় ৩ কেজি ইলিশের জন্য ভোক্তা সর্বাধিক ৩০০০ টাকার সমান উপযোগ লাভ করে। কিন্তু ৯০০ টাকা বাজার দরে ৩ কেজি ইলিশের জন্য তাকে দিতে হয়েছে ২৭০০ টাকা। অর্থাৎ ২৭০০ টাকার সমান উপযোগ হারাতে হয়েছে। অতএব, এক্ষেত্রে ভোক্তার উদ্বৃত্ত (৩০০০ টাকা – ২৭০০ টাকা) = ৩০০ টাকা।

অন্যভাবে বলা যায়, প্রতি কেজি ১১০০ টাকা দরে চাহিদা ১ কেজি, ১০০০ টাকা দরে চাহিদা ২ কেজি, ৯০০ টাকা দরে চাহিদা ৩ কেজি হলে এবং বাজার দর যদি ৯০০ টাকা হয় তবে ভোক্তার সন্তুষ্টি বা ভোক্তার উদ্বৃত্ত ৩০০ টাকা।

ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণা চিত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা

ভোক্তার উদ্বৃত্তের ধারণা চিত্রের সাহায্যেও ব্যাখ্যা করা যায়।

নিচের চিত্রে ভোক্তার উদ্বৃত্তের ধারণা দেখানো –

ভোক্তার উদ্বৃত্ত

চিত্রঃ  ভোক্তার উদ্বৃত্ত

চিত্রের OX অক্ষে দ্রব্যের চাহিদার পরিমান এবং OY অক্ষে দাম / উপযোগ ধরা হয়েছে।  DD1  হল চাহিদা রেখা বা উপযোগ রেখা। দেখা যায়, OM পরিমান দ্রব্য ক্রয় করে ভোক্তার মোট উপযোগ লাভ হয়   OMPD ক্ষেত্র। কিন্তু প্রতি একক দ্রব্য MP দামে ক্রয় করতে OM এর জন্য মোট দাম লাগে  (OM x PM) OMPK ক্ষেত্র।

এক্ষেত্রে তাই ভোগ উদ্বৃত্ত (OMPD – OMPK) = KPD ক্ষেত্র যা চিত্রে ছায়াযুক্ত স্থান দ্বারা দেখানো হয়েছে।

ব্যক্তিগত চাহিদা দাম পরিবর্তিত না হয়ে বাজার দাম কমে গেলে এ উদ্বৃত্ত বাড়ে এবংবাজার দাম বাড়লে তা কমে। রেখাচিত্রে বাজার দাম কমে NQ হলে দ্রব্যের পরিমান বেড়ে ON হয় এবং ভোগ উদ্বৃত্তের পরিমান বেড়ে দাঁড়ায় RQD ক্ষেত্রের সমান।

ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণার সমালোচনা

অনেকেই ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটির অনেক সমালোচনা করেছেন। সমালোচনাগুলি নিম্নরূপ –

১. অর্থের প্রান্তিক উপযোগঃ অর্থের প্রান্তিক উপযোগ স্থির থাকে এই অনুমানের উপর ভোগ উদ্বৃত্ত ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত কিন্তু বাস্তবে কোন দ্রব্যের বেশি একক কিনতে থাকলে ক্রেতার কাছে ক্রমশ অর্থের প্রান্তিক উপযোগ বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা কঠিন।

২. উপযোগের পরিমানঃ এই তত্ত্বে উপযোগ সংখ্যাগতভাবে পরিমাপযোগ্য ধরা হয়েছে। কিন্তু উপযোগ একটি মানসিক ধারণা বলে সব ক্ষেত্রে এর সংখ্যাগত পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

৩. অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যঃ অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে মানুষ যে কোন দাম দিতে প্রস্তুত থাকে। এক্ষেত্রে ভোগ উদ্বৃত্ত ধারণার প্রয়োগ অর্থহীন।

৪. পরিপূরক ও পরিবর্তক দ্রব্যঃ যে সব দ্রব্যের পরিপূরক ও পরিবর্তক দ্রব্য আছে তাদের ভোগ নিজস্ব দাম ছাড়াও তাদের পরিপূরক ও পরিবর্তক দ্রব্যের দামের উপর নির্ভর করে।

৫. বিলাস দ্রব্যঃ অতি বিলাসী ও জাঁকজমকপূর্ণ দ্রব্যের মর্যাদা-মূল্য আছে। তাই এসব ক্ষেত্রে দাম বাড়লে তাদের চাহিদা বাড়ে এবং দাম কমলে চাহিদা কমে। সুতরাং, এরূপ ক্ষেত্রে ভোগ উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা যায় না।

৬. অভ্যাস ও রুচিঃ বাজারে বিভিন্ন ভোক্তার অভ্যাস, পছন্দ ও রুচি বিভিন্ন রকম হয়। একটি দ্রব্য ভোগ করে এক এক জন এক এক রকম উপযোগ লাভ করে। তাই কোন দ্রব্যের সমষ্টিগত ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা যায় না।

৭. কাল্পনিক চাহিদা দামঃ দ্রব্যের চাহিদা দামের ভিত্তিতে ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা হয়। কিন্তু দ্রব্যের প্রতিটি এককের জন্য ভোক্তা কি দাম দিতে প্রস্তুত তা আগে থেকে জানা যায় না। তাই কাল্পনিক চাহিদা দামের ভিত্তিতে ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা বাস্তব সম্মত নয়।

৮. অবাস্তব ধারণাঃ অধ্যাপক নিকলসন ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটি অবাস্তব বলে আখ্যায়িত করেছেন। আধুনিককালে ক্রেতারা কোন দ্রব্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাহিদা দামের চেয়ে বেশি দামে ক্রয় করে। কাজেই, বাস্তবে প্রায় ক্ষেত্রেই ভোগ উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা যায় না।

ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটির গুরুত্বঃ

Importance of Consumer’s Surplus

ভোগকারীর উদ্বৃত্ত ধারণাটির তাত্বিক গুরুত্বের তুলনায় ব্যবহারিক গুরুত্ব বেশি। নিম্নে ইহার গুরুত্ব আলোচনা করা হলো –

  1. ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময় মূল্যের মধ্য়ে তুলনাঃ ভোগ উদ্বৃত্তের সাহায্যে কোন দ্রব্যের ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময় মূল্যের মধ্য়ে তুলনা করা যায়। কোন দ্রব্যের ভোগ উদ্বৃত্ত না থাকলে মনে করতে হবে যে উহার ব্যবহারিক মঊল্য ও বিনিময় মূল্য সমান। ভোগ উদ্বৃত্ত বেশি হলে দ্রব্যের ব্যবহারিক মূল্য বিনিময় মূল্যের চেয়ে বেশি। সাধারনতঃ অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে এরূপ হয়।
  2. একচেটিয়া কারবারীর নিকটঃ একচেটিয়া কারবারীর দ্রব্য মূল্য নির্ধারণে ভোগ উদ্বৃত্ত ধারণাটির গুরুত্ব রয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষমতা থাকলেও সে লাগামহীনভাবে মূল্য বৃদ্ধি করবে না। ক্রেতার নিকট ভোগ উদ্বৃত্ত যে পরিমানে রয়েছে, একচেটিয়া কারবারী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে সেই পরিমান ভোগ উদ্বৃত্ত হ্রাস করতে পারে। অতএব, ভোগ উদ্বৃত্ত একচেটিয়া কারবারীর দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয়।
  3. কর আরোপের ক্ষেত্রেঃ কর আরোপ করলে দ্রব্যের দাম বাড়ে এবং ক্রেতাদের ভোগ উদ্বৃত্ত কমে যায়। তাই যে কর ধার্য করলে সরকারের আয় বাড়ে কিন্তু ক্রেতাদের ভোগ উদ্বৃত্ত সে অনুপাতে কমে না, তেমন করই ধার্য করা উচিত।
  4. ভর্তুকির ক্ষেত্রেঃ কোন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিলে সরকারের কিছু অর্থ ব্যয় হয় সত্য, কিন্তু এ ব্যয় বাবদ জনগনের জন্য ভোগ উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয়। অতএব, কোন কোন ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিলে জনকল্যাণ বাড়বে তা ভোগ উদ্বৃত্ত ধারণাটির সাহায্যে নির্ধারণ করা যায়।
  5. আন্তর্জাতিক বাজারে লাভ নির্ধারণেঃ আমদানি দ্রব্যের জন্য ক্রেতারা উচ্চ দাম দিতে প্রস্তুত থাকলেও আমদানির পর তা কম দামে ক্রয় করতে পারে বলে ভোগ উদ্বৃত্ত ভোগ করে। যে দেশের মানুষের এ ভোগ উদ্বৃত্ত বেশি সে দেশের বানিজ্য থেকে লাভের পরিমানও বেশি।
  6. প্রকৃত আয় নির্ধারণঃ বাজারে সাধারন মূল্যস্তর বেশি হলে ভোগ উদ্বৃত্ত কম হবে এবং প্রকৃত আয় তথা জীবনযাত্রার মান কম হবে। আবার মূল্যস্তর কম হলে ভোগ উদ্বৃত্ত বেশি হবে এবং প্রকৃত আয় তথা জীবনযাত্রার মান বেশি হবে।
  7. জনকল্যাণমুখী ব্যয়ের ক্ষেত্রেঃ রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গণপাঠাগার, চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, রেডিও-টেলিভিশন কেন্দ্র ইত্যাদির সামাজিক প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক বেশি বলে ইহাদের ভোগ উদ্বৃত্তও অনেক বেশি। ফলে সরকারের পক্ষে এই সকল জনকল্যানমূলক কাজে বর্ধিত হারে অর্থ ব্যয় করা বাঞ্ছনীয়।

আরও পড়তে পারেন: ভোক্তার আচরণ