পণ্য ও সেবা সামগ্রী নির্বাচন, ক্রয়, সংগ্রহ বা অর্জন এবং ভোগ বা ব্যবহারকালীন সময়ে ভোক্তার মধ্যে আচরণের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাকে ভোক্তার আচরণ বলে।
Table of Contents
ক্রেতা ও ভোক্তার মধ্যে পার্থক্য
ক্রেতা কে?
Who is customer/buyer?
যিনি কোন দ্রব্য বা সেবা ক্রয় করেণ তিনি হলেন ক্রেতা বা customer বা buyer। অর্থনীতি পাঠে ক্রেতা ও ভোক্তা সমার্থক হলেও বিপণন বা Marketing-এ ক্রেতা (customer) এবং ভোক্তার (consumer) মধ্যে পার্থক্য ধরা হয়। ক্রেতা ক্রয়কৃত পণ্য বা সেবা নিজে ভোগ করতে পারেন আবার নাও পারেন।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আমি যখন নিজের জন্য জুতা কিনি তখন আমি একাধারে ক্রেতা ও ভোক্তা; কিন্তু যখন আমার ছেলে-মেয়ের জন্য জুতা কিনি তখন আমি শুধু ক্রেতা, ভোক্তা আমার ছেলে-মেয়ে। বিপণন বা Marketing-এর সময় এটিকে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ, এক্ষেত্রে ক্রেতা হিসাবে আমার মুখ্য বিবেচ্য থাকে জুতা চামড়ার নাকি সিনথেটিক, টেকসই হবে কিনা, দাম কেমন ইত্যাদি।
কিন্তু, ভোক্তা হিসাবে আমার ছেলে-মেয়ের বিবেচ্য বিষয় রং, ডিজাইন, হালের ফ্যাশন বা ট্রেন্ড ইত্যাদি (এমনও হতে পারে তারা তাদের বন্ধু বা বান্ধবী কিনেছে তা দেখে ঠিক একই জুতা কিনতে চাইবে) টেকসই হবে কিনা, দাম কেমন এগুলি তারা বিবেচনা করতে চাইবে না। বিপণন বিভাগ ভোক্তার সন্তুষ্টি বিধানে সচেষ্ট থাকে।
এমনও হয়, একজন ক্রেতা তার স্ত্রীর জন্য একটি শাড়ী কিনে বাড়িতে নেয়ার পর তার স্ত্রীর সেটি পছন্দ হল না, তাকে আবার সেটি ফেরৎ দিতে বা পাল্টিয়ে নিতে হয়।
ভোক্তা কে?
Who is consumer?
অর্থনীতি পাঠে ক্রেতা ও ভোক্তাকে একই অস্তিত্ত্ব (entity) ধরা হয়।
আমরা এখানে অর্থনীতি আলোচনা করব, তাই এখানে ভোক্তা বলতে ক্রেতা ও ভোক্তাকে একই অস্তিত্ত্ব হিসাবে ভোক্তা নামে অভিহিত করব।
যখন কোন ব্যক্তি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ভোগের উদ্দেশ্যে দ্রব্য বা সেবা ক্রয় করে অর্থনীতিতে তাকে বলা হয় ভোক্তা। যেমন- কোন ব্যক্তি যখন নিজের জন্য একটি লুঙ্গি ক্রয় করে তাহলে তাকে বলা হবে লুঙ্গির ভোক্তা, যখন স্ত্রীর জন্য শাড়ী কিনবে তখন বলা হবে শাড়ীর ভোক্তা, যখন পরিবারের জন্য চাউল কিনবে তখন বলা হবে চাউলের ভোক্তা, আত্মীয়-স্বজনের জন্য উপহার কিনলে বলা হবে সেই উপহার সামগ্রীর ভোক্তা, পরিবারের কোন অসুস্থ রোগী নিয়ে ডাক্তারের নিকট বা হাসপালে গেলে বলা হবে চিকিৎসাসেবার ভোক্তা।
ভোক্তার বৈশিষ্ট্যসমুহ
(Properties of consumers)
১। ভোক্তা ব্যক্তি বা পরিবারের সদস্য হতে পারে।
২। ভোক্তা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য পণ্য বা সেবা ক্রয় করে।
৩। ভোক্তা ক্রয়কৃত পণ্য ভোগ বা ব্যবহারের মাধ্যমে উপযোগ নিঃশেষ করে।
৪। অনেক সময় ভোক্তা নিজে অর্থ ব্যয় না করেও পণ্য বা সেবা ব্যবহার বা ভোগ করতে পারে। এখানে ভোক্তার সন্তুষ্টির বিষয়টি প্রাধান্য পায়।
৫। ভোক্তার সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে থাকে।
৬। প্রত্যেক ভোক্তা অল্প পরিমান পণ্য ক্রয় করে।
৭। ভোক্তার চুক্তি সম্পাদনের যোগ্যতা নাও থাকতে পারে।
ভোক্তার আচরণ
যারা পণ্য় বা সেবা ক্রয়, সংগ্রহ বা অর্জনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি পুরনের লক্ষ্যে উক্ত পণ্য বা সেবা ভোগ বা ব্যবহার করে তাদেরকে বলা হয় ভোক্তা। ভোগ বা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পণ্য বা সেবা ক্রয়কালে ভোক্তা বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পাদন করে। এসব কার্যাবলী সম্পাদনের ক্ষেত্রে ভোক্তার কিছু আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে যাকে ভোক্তার আচরণ বলে। নিচে ভোক্তার আচরণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা দেয়া হল-
১। Philip Kotler and Gray Armstrong বলেন, “consumer buyer behavior refers to the buying behavior of final consumer-individuals and households that buy goods and services for personal consumption.” (ভোক্তার ক্রয় আচরণ বলতে চূড়ান্ত ভোক্তার ক্রয় আচরণকে বুঝায় য়ারা ব্যক্তিগত এবং গ্রিহস্থালীর কাজের ব্যবহারের জন্য পণ্য বা সেবা সামগ্রী ক্রয় করে।)
২। Engel, Blackwell and Kollat -এর মতে “Consumer behavior is the act of individuals in obtaining and using goods and services including the decision process that precede and determine these acts.” (কার্যনির্বাহী সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াসহ পণ্য ও সেবা অর্জন এবং ব্যবহারের সাথে জড়িত কোন ব্যক্তির কার্যাবলীকে ভোক্তার আচরণ বলে।)
ভোক্তার আচরণের অনুমিতিসুহ
Assumptions of Consumer Behavior
ভোক্তার আচরণের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি অনুমান হিসাবে ধরে নিতে হয়।
১। ভোক্তার আচরণ হল প্রষেণাগত আচরণ। (লক্ষ্য পূরণের জন্য আভ্যন্তরীণ তাড়ণা বা তাগিদকে বলে প্রেষণা। অর্থাৎ প্রেষনা এমন একটি মানসিক অবস্থা যা আমাদের বিশেষ একটি ক্রিয়া সম্পাদন করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং কাজকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য মুখী করে ও লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সেই কাজে ব্যাপৃত রাখে।)
২। সময়ের পরিবর্তনে ভোক্তার আচরণের পরিবর্তন হয়।
৩। ভোক্তার আচরণ বিভিন্ন উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৪। ভোক্তার আচরণ একাধিক কার্যক্রমের সমষ্টি।
৫। ভোক্তার আচরণ পণ্য ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ক্রয় প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
ভোক্তার আচরণের বৈশিষ্ট্য
(Characteristics of Consumer Behaviors)
১। ভোক্তা আচরণে পণ্য, পরিষেবা, ক্রিয়াকলাপ এবং ধারণা জড়িতঃ
ভোক্তা আচরণের পরিধিতে কেবল পণ্য (টয়লেট সাবান, মাছ, তরকারি ইত্যাদির মতো) অন্তর্ভুক্ত নয়, পরিষেবা (চিকিৎসা সেবা, পরিবহন সেবা, ব্যাকিং সেবা, কুরিয়ার ইত্যাদি), ক্রিয়াকলাপ (শিশুদের টিকা দেওয়া, মেডিকেল ক্যাম্পিং, বৃক্ষ রোপন ইত্যাদি), এবং ধারণা (প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক নয়, মাদককে না বলা, নিরাপদ খাদ্য, পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এভাবে ভোক্তাদের আচরণ নৈবেদ্যকে (Offer) ঘিরে আবর্তিত হয়।
২। ভোক্তার আচরণ কেনার চেয়ে বেশিঃ
ভোক্তাদের আচরণ শুধু অফার কেনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভোক্তার আচরণে কেনা (অফারটি অর্জন করা), ব্যবহার এবং নিষ্পত্তি অন্তর্ভুক্ত। ব্যবহারের অনেক অর্থ রয়েছে – প্রথমত, এতে ভোক্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী প্রভাব রয়েছে। সাধারণ সময়ে মহিলাদের শাড়ী পরা লজ্জা নিবারণের জন্য, কিন্তু বিয়ের সময় বা অনুষ্ঠানে মহিলাদের দ্বারা শাড়ী-গহনা পরায় সামাজিক মূল্য রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এটি অন্যান্য আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে। পণ্য বা পরিষেবা সন্তোষজনক না হলে ভোক্তাদের অভিযোগ এবং প্রতিবাদ হতে পারে।
একটি পণ্য ভোগ করার পরে তা কিভাবে ডিসপোজ বা অবসারণ করা হবে তাও ভোক্তার আচরণের অন্তর্ভূক্ত। নতুন প্রজন্মের দর্শন হল পাশ্চাত্যদের মত জিনিস একটু পুরনো হলেই তা ফেলে দেয়া। পুরানো প্রজন্মের লোকেরা ব্যবহৃত জিনিসগুলি সহজে ফেলে দিতে চায় না- মেরামত করার পরে পুরানো জিনিস ব্যবহার করতে পছন্দ করে।
পুরনো একটি গল্প এখানে প্রাসংগিক। একলোক ১০০ টাকা দিয়ে একটি ফুলহাতা গেঞ্জি কিনে অনেক দিন পরার পরে কনুইয়ের কাছে ছিড়ে গেলে হাতার কিছু অংশ কেটে ফেলে হাফহাতা গেঞ্জি বানিয়ে পরেছে। অনেকদিন পরে হাতা আবার ছিড়ে গেলে এবার সেটি কেটে প্রথমে হাতা ছাড়া গেঞ্জি পরে স্যান্ডো গেঞ্জি বানিয়েছে। পিঠের দিকে ছিড়ে গেলে পেটের অংশ কেটে ৩টি রুমাল বানিয়েছে। রুমাল ছিড়ে গেলে তা দিয়ে টেবিল মুছেছে। শেষ পর্যন্ত টেবিল মোছা ন্যাকড়া পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দাঁত মেজে পুকুর ঘাটে কুলি ফেলে বলছে – যাহ্! আমার নগদ ১০০টাকা জলে গেল।
৩। ভোক্তা আচরণ একটি গতিশীল প্রক্রিয়াঃ
ভোক্তার আচরণ গতিশীল কারণ ভোক্তাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং কর্ম, লক্ষ্যযুক্ত গোষ্ঠী এবং বৃহত্তর সমাজ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে ভোক্তার শ্রেনী, রুচির পরিবর্তন, পেশার পরিবর্তন, আয়স্তরের পরিবর্তন, তথ্য ও জ্ঞানের পরিবর্তন, হালের ফ্যাশন, প্রযুক্তির পরিবর্তন, বিজ্ঞাপন, বৈশ্বিক পরিবর্তন, জলবায়ুর পরিবর্তন, সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন ইত্যাদির কারণে ভোক্তার আবেগ-অনুভুতি, চিন্তা-চেতনা এবং আচরণের পরিবর্তন ঘটে। যেমন-
আয়স্তর পরিবর্তণের ফলে ভোক্তা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মান নিয়ে চিন্তা করে এবং বিলাস ও সৌখিন দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে। অত্যধিক গরমে মানুষ পাতলা সূতি কাপড়ের পোশাক পরে। উদারপন্থী সরকারের আমলে মানুষ যে ধরণের পোশাক পরে রাজনৈনিক পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রদায়িক বা রক্ষণশীল সরকারের আমলে তা পাল্টে যায়। আবার কোন একটি সিনেমা হিট হলে তরুণদের মাঝে ঐ সিনেমার নায়ক নায়িকাদের পোশাকের প্রতি হঠাৎ ঝোঁক বেড়ে যায়।
ভোক্তার আচরণের পরিবর্তন হঠাৎ অথবা কয়েক প্রজন্ম ধরে সাধিত হয়। যেমন- আফগানিস্থানে রাজনৈনিক পরিবর্তনের (আগস্ট, ২০২১) সাথে সাথে কয়েক মুহুর্তের মধ্যে পোশাকে আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। বাংলাদেশে গত শতাব্দির প্রথমদিক পর্যন্ত হিন্দু মুসলমান সকল পুরুষের পরণে ধুতি দেখা যেত, এখন হিন্দু মুসলমান সবাই লুঙ্গি পরে। তরুণ প্রজন্ম আবার লুঙ্গির পরিবর্তে ট্রাউজার্স, শর্টস বা বারমুডা পরতে সাচ্ছন্দ বোধ করে। এ পরিবর্তণ এসেছে খুবই ধীরে ধীরে।
এক সময়ের প্রবাদ ছিল, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে!” আমরা ছোট বেলায় ঠিকই দুধ দিয়ে ভাত খেতাম। স্বচ্ছল পরিবারের সবাই খাবারের শেষের দিকে দুধ দিয়ে এক থালা ভাত খেত। এটি ছিল নিয়মিত ডেসার্ট।
সময়ের পরিবর্তনে প্রযুক্তির প্রসারে মানুষের কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়ায় ভাতের চাহিদা কমে গেছে। মানুষ এখন ভাত কম খায়। তাই ভাতের সাথে দুধ খাওয়া হয় না। গ্লাস, মগ বা কাপে করে মানুষ দুধ পান করে। কিন্তু আমাদের পরবর্তী পজন্ম? তারা দুধ এভাবে খেতে চায় না। যারা বাড়িতে বা বাসায় এভাবে দুধ খেতে চায় না তারাই আবার বাইরে গিয়ে চকোলেট মিল্ক, মিল্ক ক্যান্ডি, মিল্ক শেক, আইসক্রীম ইত্যাদি আকারে দুধ পছন্দ করছে। ফাস্ট ফুডের দোকানে পিজ্জা ইত্যাদির চাহিদা বাড়ায় এবং বাসা বাড়িতে ইউটিউব ভিত্তিক বিদেশি রন্ধন শৈলীর প্রভাবে পনির বা চিজের চাহিদা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাই ভোক্তার এই আচরণের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে সনাতন উৎপাদন ধারণা থেকে বের হয়ে চাহিদা ভিত্তিক ভ্যালু এ্যাডেড প্রডাক্ট তৈরি করার। বাংলাদেশে পরিকল্পিত এগ্রো-ফুড ভেলু চেইন তেরি ও রক্ষা করতে না পারলে বাজারের এই চাহিদা অপূর্ণ থাকবে না – দখল করে নেবে বিদেশি জায়ান্টরা। আমাদের দেশীয় প্রান্তিক ও মাঝারী খামারীরা সনাতন প্রডাক্ট নিয়ে লোকশান গুনবে আর বিদেশি কোম্পানিগুলি ভেলু এ্যাডেড প্রোডাক্ট রপ্তানি করে এদেশ থেকে মোটা মুনাফা তুলে নিয়ে যাবে।
৪। ভোক্তার আচরণ অনেক মানুষের মিথস্ক্রিয়াঃ
ভোক্তা আচরণের অর্থ একক ব্যক্তির ক্রিয়া নয়। বন্ধুবান্ধব, কয়েকজন সহকর্মী বা পুরো পরিবারের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া হতে পারে। ব্যক্তিরা বিভিন্ন ভূমিকা নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গাড়ি কেনার জন্য বন্ধু-বান্ধব, ইন্টারনেট, বিজ্ঞাপন, বিক্রয় প্রতিনিধি, এজেন্ট প্রভৃতির মাধ্যমে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করতে পারে, ছোট বাচ্চা কেনার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে, বাবা -মা কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত পরিবার প্রধান ক্রেতা হিসাবে ক্রয় কার্য সম্পাদন করতে পারে। গাড়িটি পরিবারের একজন বা সকল সদস্য ব্যবহার করতে পারে। একইভাবে গাড়ির নিষ্পত্তি করতে পরিবারের অনেক সদস্য জড়িত থাকতে পারে।
৫। ভোক্তার আচরণে অনেক সিদ্ধান্ত জড়িতঃ
ভোক্তা সিদ্ধান্ত নেয় কি কিনবে বা ব্যবহার করবে বা বর্জন করবে; কেন কিনবে (সুবিধা কি); কখন কিনবে; কোথায় কিনবে (স্থান, আউটলেট বা কার কাছ থেকে কিনবে), কিভাবে (নগদ, ধারে, কিস্তিতে, লোনে), কত পরিমানে কিনবে; কত ঘন ঘন কিনবে (ফ্রিকোয়েন্সি); কতক্ষণ ব্যবহার করবে; ব্যবহার শেষে কিভাবে ডিসপোজ বা বর্জন করবে?
অনুরূপভাবে উৎপাদনকারী বা বিপননকারীর ভোক্তার এই আচরণ বোঝার প্রয়োজন আছে যে (কোন অফার অর্জন/ব্যবহার/নিষ্পত্তি করতে হবে), কি (অর্জন/ব্যবহার/নিষ্পত্তি), কেন (একটি অর্পণ অর্জন/ব্যবহার/নিষ্পত্তি করতে হবে বা হবেনা)), কখন (সময়), কোথায় ( স্থান), কিভাবে (অর্জন, ব্যবহার এবং নিষ্পত্তি করার উপায়), কত (ভলিউম), কত ঘন ঘন (ফ্রিকোয়েন্সি), এবং কতক্ষণ (কতক্ষণ পর্যন্ত) ভোক্তারা কোন অফার কিনবে, ব্যবহার করবে বা নিষ্পত্তি করবে।
৬। ভোক্তারআচরণে বিনিময় জড়িতঃ ভোক্তার আচরণে মানুষের মধ্যে বিনিময় জড়িত। মূল্যবান কিছু পাওয়ার জন্য মানুষকে মূল্যবান কিছু দিতে হয়। আবার, মানুষকে একটি সুযোগ বা সুবিধা অর্জন করতে গেলে অপরাপর সুযোগ বা সুবিধা ত্যাগ করতে হয়। য়াকে বলে সুযোগ ব্যয় (Oportunity cost). ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কেই এই সুযোগ ব্যয় বিবেচনা করতে হয়। কোন জিনিসের উপযোগ যদি সুযোগ ব্যয়ের চেয়ে বেশি না হয় তবে যুক্তিবাদী মানুষ তা অর্জন করতে প্রবৃত হবে না।
ভোক্তার আচরণের প্রকারভেদ
(Types of Consumer Behaviors)
ভোক্তার ক্রয় সিদ্ধান্ত নির্ভর করে তাদের কোন ধরনের পণ্য কিনতে হবে তার উপর। চা কেনার সময় একজন ভোক্তার আচরণ আর শাড়ি কেনার সময় তার আচরণ অনেক ভিন্ন। পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে এটি স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, জটিলতর এবং ব্যয়বহুল কেনাকাটার সময় উচ্চতর চিন্তাভাবনা এবং তুলনামূলক অনেক বেশি অংশগ্রহণকারী জড়িত হয়। একজন ভোক্তার ক্রয়ের সিদ্ধান্তে তার অংশগ্রহণের স্তর দ্বারা ভোক্তার কেনার আচরণ নির্ধারিত হয়।
একটি ক্রয়ে জড়িত ঝুঁকির পরিমাণও ক্রয় আচরণ নির্ধারণ করে। উচ্চমূল্যের পণ্যগুলি উচ্চতর ঝুঁকিপূর্ণ থাকে, যার ফলে সেগুলি কেনার সিদ্ধান্তে উচ্চতর হিসাব নিকাশ বা বিশ্লেষণ জড়িত থাকে।
সবকিছু বিবেচনা করে চার ধরণের ভোক্তার আচরণ নির্ণয় করা হয়েছে – (ক) জটিল ক্রয় আচরণ, (খ) অসামঞ্জস্য ক্রয় আচরণ, (গ) অভ্যাসগত ক্রয় আচরণ ও (ঘ) বৈচিত্র্য চাওয়া ক্রয় আচরণ।
(ক) জটিল ক্রয় আচরণঃ
যখন ভোক্তারা একটি ব্যয়বহুল পণ্য ক্রয় করে তখন তাদের আচরণ জটিল হয়। কারণ, ভোক্তার কাছে এটি একটি অনিয়মিত এধরণের ক্রয়, মানুষ নিত্য নিত্য ব্যয়বহুল জিনিস কেনে না (যেমন গাড়ি, ফ্লাট ইত্যাদি)।
এক্ষেত্রে ভোক্তারা ক্রয়ের আগে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করবে। একটি ব্যয়বহুল পণ্য বা তার কাছে অপরিচিত পণ্য কেনার সময় ভোক্তা খুব আলাদা আচরণ করে। যখন একটি পণ্য কেনার ঝুঁকি খুব বেশি থাকে, একজন ভোক্তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বন্ধু, পরিবার এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন একজন ভোক্তা প্রথমবারের মতো একটি গাড়ি কিনেন, তখন এটি একটি বড় সিদ্ধান্ত, কারণ এতে উচ্চ অর্থনৈতিক ঝুঁকি রয়েছে। এটি কেমন দেখাচ্ছে, তার বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে, গাড়ি কেনার পর তার সামাজিক মর্যাদা কিভাবে পরিবর্তন হবে ইত্যাদি নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা রয়েছে। জটিল ক্রয় আচরণে, ক্রেতা একটি শেখার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। তিনি প্রথমে পণ্য সম্পর্কে বিশ্বাস গড়ে তুলবেন, তারপর মনোভাব, এবং তারপর একটি চিন্তাশীল ক্রয় পছন্দ করবেন।
জটিল ক্রয় আচরণ গ্রাহকদের জন্য, বিপণনকারীদের পণ্য সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকতে হবে। কারণ তাদের দায়িত্ব ভোক্তাকে তাদের পণ্য সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করা।
(খ) অসামঞ্জস্য ক্রয় আচরণঃ
অসামঞ্জস্যতা-ক্রেতা আচরণে ভোক্তাদের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি। তবে, এক্ষেত্রে ভোক্তাদের গবেষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ খহুবই সীমিত থাকে। কারণ, উচ্চ মূল্য, অনিয়মিত ক্রয়, ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে কম তাৎর্যপূর্ণ পার্থক্যসহ ভোক্তার পছন্দসই পন্যের স্বল্পপ্রাপ্যতার জন্য ভোক্তা এমন একটি পণ্য ক্রয় করে যা তার বাজেটের মধ্যে সহজেই পাওয়া যায়। ভোক্তারা এমন পণ্য কিনতে বাধ্য হবে যার খুব বেশি বিকল্প পছন্দ (Alternate choice) নেই এবং তাই সময়ের সীমাবদ্ধতা বা বাজেটের সীমাবদ্ধতার উপর ভিত্তি করে ভোক্তারা পর্যাপ্ত গবেষণা বা যাচাই বাছাই ছাড়াই নির্দিষ্ট পণ্য কিনে থাকেন।
উদাহরণস্বরূপ, ট্রেন ছাড়িবার পূর্বে একজন ক্ষুধার্ত যাত্রী স্টেশনে যা পাওয়া যায় তেমন কিছু খাবার সংগ্রহ করবেন – এক্ষেত্রে তার সময়ের স্বল্পতা এবং পছন্দসই খাবার (পণ্য়) দুষ্প্রাপ্যতা রয়েছে।
(গ) অভ্যাসগত ক্রয় আচরণঃ
অভ্যাসগত ক্রয় আচরণে একটি ক্রয় সিদ্ধান্তে একজন ভোক্তার কম সম্পৃক্ততা দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে ভোক্তা ব্র্যান্ডের মধ্যে মাত্র কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য উপলব্ধি করে। যখন ভোক্তারা তাদের দৈনন্দিন রুটিনের জন্য ব্যবহার করা পণ্য কিনেন, তখন তারা খুব বেশি চিন্তা করেন না। তারা হয় তাদের পছন্দের ব্র্যান্ডটি কিনেন বা যেটি তারা নিয়মিত ব্যবহার করেন- অথবা দোকানে পাওয়া যায় অথবা যেটির দাম কম সেটি কিনেন।
উদাহরণস্বরূপ, যখন একজন ভোক্তা একটি রুটি কিনেন, তখন তিনি অনেক গবেষণা এবং সময় ব্যয় না করেই যে ব্র্যান্ডটির সাথে তিনি পরিচিত তা কিনেন। অনেক পণ্য এই বিভাগে ফিট। নিত্য ব্যবহার্য পণ্য, যেমন লবণ, চিনি, বিস্কুট, টয়লেট পেপার, সাবান, ডিটারজেন্ট ইত্যাদি সবই এই পণ্যের ক্যাটাগরিতে মানানসই। ভোক্তা কেবল এটির জন্য যান এবং এটি কিনে আনেন। এই ধরনের পণ্য কেনার বিষয়ে ভোক্তাদের গবেষণা বা তথ্যের প্রয়োজন হয় না। রেডিও, টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়া দ্বারা অভ্যাসগত ক্রয় আচরণ প্রভাবিত হয়। তাছাড়া, ভোক্তারা ব্র্যান্ড পরিচিতির ভিত্তিতে কিনছেন।
তাই মার্কেটারদের অবশ্যই ব্র্যান্ড পরিচিতি তৈরি করতে পুনরাবৃত্তিমূলক বিজ্ঞাপন ব্যবহার করতে হবে। প্রোডাক্ট ট্রায়াল শুরু করার জন্য, মার্কেটারদের প্রাইস ড্রপ প্রোমোশন এবং সেলস প্রোমোশনের মত কৌশল ব্যবহার করা উচিত। বিপণনকারীদের তাদের বিজ্ঞাপনে চাক্ষুষ প্রতীক এবং চিত্র ব্যবহার করে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করা উচিত। ভোক্তারা সহজেই চাক্ষুষ বিজ্ঞাপন মনে রাখতে পারে এবং একটি ব্র্যান্ডের সাথে যুক্ত হতে পারে।
(ঘ) বৈচিত্র্য চাওয়া আচরণঃ
এক্ষেত্রে, ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকে। এখানে ভোক্তারা প্রায়ই অনেক ব্র্যান্ড সুইচিং করে। পণ্যগুলি স্যুইচ করার খরচ কম এবং তাই ভোক্তারা কৌতূহলবশতঃ বা একঘেয়েমি থেকে বের হয়ে আসার জন্য নতুন পণ্য ব্যবহার করতে চাইতে পারেন। এখানে ভোক্তারা সাধারণত অসন্তুষ্টির কারণে নয় বরং প্রধানত বৈচিত্র্য খোঁজার তাগিদে বিভিন্ন পণ্য কিনে থাকেন।
উদাহরণস্বরূপ, একটি ভোক্তা একটি কুকি কিনতে পছন্দ করে এবং একটি ব্র্যান্ডকে খুব বেশি চিন্তা না করে বেছে নেয়। পরের বার, একই ভোক্তা হয়তো ভিন্ন স্বাদের জন্য একটি ভিন্ন ব্র্যান্ড বেছে নিতে পারে। ব্র্যান্ড সুইচিং প্রায়ই এবং উদ্দেশ্য ছাড়া ঘটে। এই ধরনের ভোক্তা আচরণের জন্য ব্র্যান্ডকে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। মার্কেট লিডার শেলফ স্পেসকে প্রভাবিত করে অভ্যস্ত ক্রয় আচরণকে প্ররোচিত করবে। বিক্রেতা তার ডিসপ্লেতে প্রচুর সংখ্যক সম্পর্কিত কিন্তু বিভিন্ন পণ্যের সংস্করণ প্রদর্শন করে। বিপণনকারীরা স্টক-আউট স্টক এড়িয়ে যান, ঘন ঘন বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, কম দাম, ডিসকাউন্ট, ডিল, কুপন এবং বিনামূল্যে নমুনা অফার করে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য।
উপসংহারঃ
ভোক্তার পন্য বা সেবা কেনার সিদ্ধান্তগুলি ভোক্তার আচরণের উপর নির্ভর করে। লবন কেনার বিপরীতে গাড়ি কেনার সময় ভোক্তাদের আচরণে দারুণ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তাই পন্য ডিজাইন ও বিপণনের ক্ষেত্র উৎপাদনকারী এবং অথবা বিপণনকারীদের বিভিন্ন ধরণের ভোক্তা আচরণ বিবেচনায় নিতে হয়।
ভোগ বা Consumption সম্পর্কে জানতে এখানে CLICK করুন
আরও পড়তে পারেন: ভোক্তার উদ্বৃত্ত
[…] আরও পড়তে পারেন: ভোক্তার আচরণ […]
[…] আরও পড়ুন: ভোক্তার আচরণ […]
[…] ভোক্তা হিসাবে আমাদের যুক্তিশীল আচরণ করতে হবে। আসলে তা আমরা করি না। অর্থনীতির প্রতিটা সূত্রের অনুমিতি (Assumption) হচ্ছে অর্থনীতির প্রতিটি খেলোয়াড় যুক্তিশীল আচরণ করবে – তাহলেই সুত্রগুলি কার্যকর প্রতীয়মান হবে। যে করবে না সে অযোগ্য, হুমজিক্যালি সে ফাউল করে বসবে অথবা নির্বিবাদে পরাজয় স্বীকার করবে। […]