গবাদি পশুর খামার পরিচালনার জন্য সুস্থ গরু ও অসুস্থ গরু সনাক্ত করতে পারা অত্যন্ত জরুরী। পালের অসুস্থ গরু যত দ্রুত সনাক্ত করা যাবে খামারের ঝুঁকি তত হ্রাস পাবে। খামারে লাভ বেশি হবে। অসুস্থ গরু সনাক্ত করতে যত দেরি হবে ব্যবস্থা নিতেও তত বিলম্ব হবে। ফলে রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে, ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি ঘটবে, চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে, অসুস্থ গরু থেকে সুস্থ গরুতে রোগ সংক্রমনের আশঙ্কা বাড়বে। আবার, গরু বাছুর কেনার সময়ও সুস্থতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে কিনতে হবে। শুধু গরু নয় সমস্ত গৃহপালিত এবং খামারে পালিত পশু-পাখীর বেলায় এটি প্রযোজ্য। খামারের আয় বৃদ্ধি পেলে মোট দেশজ উৎপাদন এবং মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে তাই জেনে নেয়া দরকার কিভাবে সুস্থ ও অসুস্থ গরু সহজে চেনা যাবে।
Table of Contents
সুস্থ গরু চেনার উপায়
- সুস্থ গরুর কাছে মানুষ গেলে সে ব্যক্তি বিবেচনায় সাড়া দেবে। পরিচিত লোক বা পরিচর্যাকারীকে দেখলে সে আগ্রহ ও উৎফুল্লতা দেখাবে – তার দিকে এগিয়ে আসবে বা মাথা এগিয়ে দেবে। অপরিচিতজনের প্রতি সতর্কতা প্রদর্শন করবে – হয় সরে যেতে অথবা আক্রমন করতে চেষ্টা করবে।
- স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করবে।
- লেজ নাড়বে।
- গায়ের পশম মসৃণ ও চকচকে থাকবে।
- গায়ের চামড়া মোলায়েম ও ঢিলা থাকবে। চামড়া ধরে টেনে ছেড়ে দিলে দ্রুত গায়ের সাথে মিশে যাবে।
- চোখ উজ্জ্বল ও পরিস্কার থাকবে।
- নাক বা উপরের ঠোঁট (Muzzle) বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেজা থাকবে।
- শরীরের কোথাও কোন অসামঞ্জস্য থাকবে না।
- খাওয়ায় রুচি থাকবে।
- সুস্থ গরু অবসরে জাবর কাটে ।
- গাভীর ওলান সুগঠিত ও নরম থাকবে। বাটগুলি সমান থাকবে।
- গোবর অতিরিক্ত শক্ত ও অতিরিক্ত নরম থাকবে না। পায়খানায় দুর্গন্ধ থাকবে না।
- নিঃশ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে।
- শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে।
অসুস্থ গরু চেনার উপায়
- আগন্তুকের আগমনে সুস্থ পশুর ন্যায় উদ্দীপনায় সাড়া দেবে না।
- উপরের ঠোঁট বা নাকের অগ্রভাগ শুস্ক থাকতে পারে। সুস্থ গরুতে এখানে বিন্দু বিন্দু ঘাম থাকে।
- মুখ দিয়ে লালা ঝরতে পারে।
- খাবার গ্রহনে অরুচি থাকতে পারে।
- অসুস্থ গরু সাধারণত জাবর কাটে না।
- নাক দিয়ে শ্লেষ্মা বের হতে পারে।
- শ্বাস প্রশ্বাসে অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে।
- চোখ থেকে পানি পড়তে পারে। চোখে পিচুটি থাকতে পারে। চোখের ঝিল্লি ফ্যাকাসে হতে পারে।
- চোখের রঙ অতিরিক্ত লাল বা হলুদ হতে পারে।
- কান দিয়ে পুঁজ বের হতে পারে ও দুর্গন্ধ থাকতে পারে।
- সুস্থ গরু সর্বদা লেজ নাড়তে থাকে। অসুস্থ গরু গায়ে মশা মাছি পড়লেও লেজ নাড়ে না।
- গায়ের পশম উস্ক খুস্ক থাকতে পারে। পশম গায়ের সাথে মিশে না থেকে খাড়া হয়ে থাকতে পারে।
- গায়ের চামড়া রুক্ষ ও শক্ত থাকবে। চামড়া ধরে টেনে ছেড়ে দিলে সহসা গায়ের সাথে মিশে যাবে না।
- ত্বকে ক্ষত বা আঁচিল থাকতে পারে।
- বাছুরের নাভী ফোলা ও শক্ত হতে পারে।
- গরু হাঁটার সময় খোঁড়াতে পারে।
- গরুকে পুস্টিহীন দেখা যেতে পারে।
- গোবর অতিরিক্ত শক্ত ও অতিরিক্ত নরম হতে পারে। পায়খানায় দুর্গন্ধ থাকতে পারে। শরীরে পাতলা পায়খানা লেগে থাকতে পারে।
- গরুর গায়ে, পায়ে বা অন্য কোন অঙ্গে অসংগতি থাকতে পারে।
- গাভীর ওলান শক্ত ও ফোলা হতে পারে। ওলানের ৪টি কোয়ার্টার অসমান হতে পারে। গাভীর বাটগুলি অসমান ও কোনটি শক্ত হতে পারে।
- শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বা কম হতে পারে।
সুস্থ পশুর দৈহিক তাপমাত্রা
পশু সুস্থ কি অসুস্থ তা বুঝার জন্য সুস্থ পশুর দৈহিক তাপমাত্রা জানা থাকা দরকার। পশু অসুস্থ হলে প্রায়শই তার দৈহিক তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে, যদিও অন্যান্য কারণেও তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়ে থাকে। নিম্নে সুস্থ্য পশুর দৈহিক তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলো বর্ণনা করা হলো-
- সুস্থ পশুর দৈহিক তাপমাত্রা সকাল বেলা বেশি থাকে এবং বিকাল বেলা কিছুটা কম থাকে।
- প্রজননের সময় তাপমাত্রা বাড়ে।
- গর্ভাবস্থার শেষ দিকে দৈহিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
- দীর্ঘক্ষণ কঠোর পরিশ্রমের ফলে দৈহিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
- খাদ্য গ্রহনের পর দৈহিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
- পানি পান করার পর হঠাৎ দৈহিক তাপমাত্রা কমে যায়।
- মিল্ক ফিভার রোগে গরুর দৈহিক তাপমাত্রা হ্রাস পায়।
তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য পশুর মলদ্বারে থার্মোমিটার ২ মিনিট প্রবেশ করিয়ে রাখতে হয়। তারপর থার্মোমিটার বের করে পারদের লেভেল দেখে তাপমাত্রা নির্ণয় করা হয়। আধুনিক কালে ডিজিটাল থার্মোমিটারও ব্যবহার করা হয়।
নিম্নে কিছু পশুর স্বাভাবিক দৈহিক অবস্থার তারমাত্রা লিপিবদ্ধ করা হলো-
পশুর ধরণ | তাপমাত্রা (ফারেনহাইট) |
বাছুর | ৯৯°-১০২° |
গাভী ও মহিষ | ৯৯.৫°-১০৩° |
ষাঁড় | ১০১°-১০৩° |
ছাগল (বয়স্ক) | ১০১.৩°-১০৪° |
ছাগল (বাচ্চা) | ১০১.৩°-১০৪.৯° |
ভেড়া (বয়স্ক) | ১০১.৩°-১০৪° |
ভেড়া (বাচ্চা) | ১০১.৩°-১০৪.৯° |
পশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার
পশু সুস্থ না কি কোন রোগে আক্রান্ত তা পরীক্ষা করার জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের হার নির্ণয় করা হয়। হাল্কা ও সুস্থ পশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার স্বাভাবিক, কিন্তু হৃষ্ট-পুষ্ট ও অসুস্থ পশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার তুলনামূলক বেশি। বিঋইন্ন কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের হারে পরিবর্তন হতে পারে-
- পশুর পাকস্থলী খাদ্যে পরিপূর্ণ থাকলে।
- পশুর গর্ভাবস্থায় ।
- পশুর কঠিন পরিশ্রমের পরে।
- অত্যধিক গরম পরিবেশে।
পেট এবং বুকের ওঠানামা গননা করে অথবা স্টেথেস্কোপের সাহায্যে বুকের শব্দ গননা করে পশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার নির্ণয় করা যায়। পশুর নাকের সামনে হাত রেখেও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার নির্ণয় করা যায়।
পশুর ধরণ | শ্বাস-প্রশ্বাস হার (প্রতি মিনিটে) |
বাছুর(গরু/ মহিষ) | ৩০-৪০ |
গরু/ মহিষ (বয়স্ক) | ১২-১৬ |
ছাগল (বাচ্চা) | ১২-২০ |
ছাগল (বয়স্ক) | ১২-১৫ |
ভেড়া (বাচ্চা) | ১৫-২০ |
ভেড়া (বয়স্ক) | ১৫-১৮ |
বিভিন্ন প্রজাতির পশুর হৃদস্পন্দনের হার
পশুর জাত ও দেহের আকার অনুসারে হৃদস্পন্দনের হারে ভিন্নতা দেখা যায়। পশুর রান অথবা চোয়ালের ধমনীতে হাতের আঙ্গুলের মৃদু চাপ প্রয়োগ করে হৃদস্পন্দন উপলব্দি করা যায়। প্রতি মিনিটে আঙ্গুলে যত বার রক্তের ধাক্কা অনুভূত হয় তাকে হৃদস্পন্দন হার বলে। পশুর বুকে হৃৎপিন্ড বরাবর স্টেথোস্কোপ দিয়েও হৃদস্পন্দন শোনা যায়। অল্পবয়সী পশুতে হৃদস্পন্দন হার বেশি থাকে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা কমতে থাকে। নানা ধরনের রোগের ক্ষেত্রেও হৃদস্পন্দনের হারে পরিবর্তন ঘটে। এছাড়াও বিভিন্ন রকম শারীরিক অবস্থায় হৃদস্পন্দন হারের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
- গর্ভাবস্থার শেষ দিকে
- প্রজননের সময়
- অত্যধিক উত্তেজনা
- কঠোর পরিশ্রম
পশুর ধরণ | হৃদস্পন্দন হার (প্রতি মিনিট) |
বাছুর (১দিন) | ১১৬-১৪০ |
বাছুর (১বছর) | ৯০-১০০ |
গাভী ও মহিষ | ৬০-৯০ |
ষাঁড় (গরু/ মহিষ) | ৩৫-৫৫ |
ছাগল (বাচ্চা) | ৮০-১১০ |
ছাগল (বয়স্ক) | ৭০-৯০ |
ভেড়া (বাচ্চা) | ৮৫-৯৫ |
ভেড়া (বয়স্ক) | ৬৫-৮৫ |
সুস্থ অসুস্থ গরু চেনার উপায় নিয়ে অনলাইনে অনেক আর্টিকেল পড়েছি। ঘুরেফিরে সব জায়গায় একই কথা। আপনার লেখায় সত্যিই আলাদা কিছু পেয়েছি, বিস্তারিত সুন্দর আলোচনা। ধন্যবাদ স্যার।
পড়া এবং সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
চেষ্টা করি গতানুগতিকতার বাইরে আহরিত জ্ঞাণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে সহজবোধ্য সাবলীল ভাষায় লিখতে।
ধন্যবাদ তোফায়েল
[…] দুর্বল ও দ্রুত হৃদস্পন্দন […]
[…] শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। […]
[…] শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। […]
[…] শ্বাস—প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। […]
সুস্থ গরু দৈনিক কতবার ওঠাবসা করে