মুদ্রাস্ফীতি

মুদ্রাস্ফীতি

মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতি সামস্টিক অর্থনীতির একটি গুরত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।  এ বিষয়ে আমাদের সবারই কমবেশি একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাই, এই আর্টিকেলে মুদ্রাস্ফীতি কি, এর প্রকারভেদ,  কেন হয়  ও মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

মুদ্রাস্ফীতি কি 

কোন নির্দিষ্ট সময়কালে (সাধারণত এক বৎসর) পণ্য-সেবার মূল্য স্থানীয় মুদ্রার অংকে বেড়ে গেলে অর্থনীতির ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতি  বা ইরেজিতে Inflation বলা হয়।

সাধারণত পণ্যদ্রব্য বা সেবার দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ওই পণ্য বা সেবা ক্রয়ে বেশি পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন বা একই পরিমান মুদ্রা দিয়ে আগের তুলনায় কম দ্রব্য বা সেবা পাওয়া যায়।

ধরা যাক, ২০১৯ সালে ১ কেজি চালের দাম ৪০ টাকা হলে ২০০ টাকায় ৫ কেজি চাল পাওয়া যেত। ২০২০ সালে চালের দাম বেড়ে কেজি প্রতি ৫০ টাকা হলে ৫ কেজি চাল কিনতে ২৫০ টাকা লাগবে। অন্যভাবে বলা যায়, ২০২০ সালে ২০০ টাকায় ৪ কেজি চাল পাওয়া যাবে।

 আবার ধরা যাক, ২০১৯ সালে একটি নদী পার হতে ফেরি ভাড়া ছিল  মাথা প্রতি ২০ টাকা, তখন ২০০ টাকায় ১০ জন লোক এক বার অথবা এক জন লোক ১০ বার  নদী পার হতে পারত। ২০২০ সালে মাথা প্রতি  ফেরি ভাড়া ২৫ টাকা হওয়ায় ১০ জন লোক এক বার অথবা এক জন লোক ১০ বার  নদী পার হতে ২৫০ টাকা লাগবে। অন্যভাবে বলা যায়, তখন ২০০ টাকায় ৮জন লোক এক বার অথবা এক জন লোক ৮ বার  নদী পার হতে পারবে।

উভয় ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এক বছর ব্যাবধানে পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবা পেতে বেশি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে বা নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ দিয়ে পূর্বের তুলনায় কম পণ্য বা সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

সুতরাং, দেখা যায় মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। একইভাবে অর্থনীতিতে অর্থের প্রকৃত বিনিময় মূল্য কমে যায়। সাধারণত মূল্যস্ফীতি সূচকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় যাকে “মুদ্রাস্ফীতি সূচক” বলে।

মুদ্রাস্ফীতির প্রকারভেদ / মুদ্রাষ্ফীতি কত প্রকার ও কি কি?

মুদ্রাস্ফীতি ২ প্রকার।

বাড়ন্ত চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি (Demand Pull Inflation):

বাড়ন্ত চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতির কারণ

যখন কোন দ্রব্য বা সেবার চাহিদা বাড়ে কিন্তু সেই অনুপাতে তার উৎপাদন বা যোগান বাড়েনা বা অপরিবর্তিত থাকে তখন সেই দ্রব্য বা সেবার দাম বাড়ে। যেমন, করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর কারণ লক ডাউনের ফলে শ্রমিক, কাঁচামাল ইত্যাদির যোগান বা সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হওয়ায় উৎপাদনশীলতা দারুণভাবে ধাক্কা খেয়েছে। এদিকে চাহিদা খুব একটা কমেনি; কারণ খাদ্য মানুষের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন।

 

ডিমান্ড পুল ইনফ্লেশনের কারণ

  • আয় বৃদ্ধি: মানুষের আয় বেড়ে গেলে তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ( আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে আমিষ জাতীয় খাদ্য, ভোগ্য পণ্য, উন্নত সেবার চাহিদা বৃদ্ধি পায়)

  • কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধি: কালোবাজারি, মজুদ্দার বা ফড়েদের কারসাজিতে বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়।

  • জনসংখ্যা বৃদ্ধি: জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের একক চাহিদা স্থির থাকলেও বাজারে মোট চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

  • সরকারের খরচ বৃদ্ধি: সরকারি খরচ যত বৃদ্ধি পাবে পক্ষান্তরে সেই অর্থ জনগণের হাতে আসবে। এবং পরোক্ষভাবে পণ্য-সেবার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।

  • অর্থনৈতিক ভর্তুকি: প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থনৈতিক ভর্তুকি দিলে সেই অর্থ জনগণের হাতে চলে আসায় জিনিসের দাম বাড়ে।

  •  সরকারের বৈদেশিক বানিজ্যিক ঋণ: সরকারের বৈদেশিক বানিজ্যিক ঋণ বাড়লে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমে।

  • সরকার অতিরিক্ত নোট ছাপালে: সরকার অতিরিক্ত নোট ছাপালে বাজারে প্রচুর টাকা চলে আসে এবং পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের ফলে মূল্যস্ফীতি ঘটে।

উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি (Cost Push Inflation)

  • যখন কোন জিনিস তৈরি করতে যেসব সামগ্রী লাগে তার দাম বৃদ্ধি পায় তখন  উৎপাদিত জিনিসটির দাম সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পায়।

কোন দ্রব্য/সেবা উৎপাদনের পিছনে ৪টি ফ্যাক্টর কাজ করে – জমি, শ্রম, মূলধন এবং সংগঠন বা উদ্যোগ (Land, Labour, Capital and Organization/Entreprenuer). এই ৪টিকে বলা হয় ‘ফ্যাক্টর অব প্রডাকশন’। এই ফ্যাক্টরগুলির এক বা একাধিকটির খরচ বৃদ্ধি পেলে দ্রব্য বা সেবার উৎপাদন খরচ (প্রডাকশন কস্ট) বৃদ্ধি পাবে।

  • পাশাপাশি দ্রব্যটি যখন বাজারে আসে তখন তার উপর সরকার পরোক্ষ কর আরোপ করে। উৎপাদন খরচের সাথে পরোক্ষ কর যুক্ত হয়ে দ্রব্য/সেবার বাজার মূল্য (মার্কেট প্রাইস) নির্ধারিত হয়। তাই সরকার ট্যাক্স বাড়ালেও জিনিসের দাম বাড়ে।

  • আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে পরিবহনের দাম বেড়ে পণ্যের দাম বাড়ায়।

মুদ্রাস্ফীতির ফলে কি হয়? / মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব

সহজ ভাষায় বলা যায় মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। একইভাবে অর্থনীতিতে অর্থের আসল বিনিময়মূল্য কমে যায়।

মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে একাধারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে নগদ অর্থের সুযোগ ব্যয় কমে যায় অর্থাৎ মানুষ যদি পণ্য না কিনে অর্থ জমা রাখে পরবর্তীতে সেই অর্থ দ্বারা পূর্বের সমপরিমান পণ্য ক্রয় করতে পারবে না বা কম পরিমান পণ্য ক্রয় করতে হবে। তাই মানুষ নগদ অর্থ সঞ্চয়ের বদলে তা খরচ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। আবার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে মানুষ বেশি অর্থ খরচ করতে বাধ্য হয়। ফলে মানুষের সঞ্চয় কমে যায় এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (বাণিজ্যিক ব্যাংক ইত্যাদি) সঞ্চয়ের অভাবে পড়ে এবং অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে আসে।

 এ ছাড়াও মূল্যস্ফীতির ফলে সীমিত/নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার পুননির্ধারণ করতে হয়।

অপরদিকে ইতিবাচক প্রভাব হল পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা বেশি পরিমানে পণ্য বা নতুন পন্য উৎপাদনে উৎসাহী হয় এবং নতুনভাবে বিনিয়োগ করে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। যার মাধ্যমে নতুন উপভোক্তা তৈরি হয়।

রপ্তাণিকারকরা তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ভাঙিয়ে বেশি পরিমানে স্থানীয় মুদ্রা লাভ করে। ফলে রপ্তাণি বানিজ্য উৎসাহিত হয় এবং নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।

প্রবাসী নাগরিকরা বিদেশে বেশি অর্থ খরচ না করে অধিক পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠায়।

মুদ্রাস্ফীতির কারণ /  মূল্যস্ফীতি কেন হয়

মুদ্রাস্ফীতির ২টি কারণ – চাহিদাজনিত এবং মূল্যজনিত। উভয়ই একটি অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির জন্য সমানভাবে দায়ী। তবে তারা ভূমিকা রাখে ভিন্নভাবে। যখন ভোক্তার দিক থেকে চাহিদা বাড়ে তখন ‘চাহিদাজনিত’ কারণে মূল্য বাড়ে। আবার উৎপাদন/সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধির পেলেও পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায় – এটি হল ‘মূল্যজনিত’ মূল্যস্ফীতি।

চাহিদাজনিত মুদ্রাস্ফীতির কারণ 

চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি ক্রমবর্ধমান দামের সর্বাধিক কারণ। পণ্য/সেবার জন্য ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধির হার উৎপাদন/সরবরাহ বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই পণ্য/সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়। নিম্নোক্ত পরিস্থিতিতে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি ঘটে-

  • ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি –

  • বিবেচনামূলক আর্থিক নীতি-

  • বিপনন এবং নতুন প্রযুক্তি-

  • সম্পদের মূল্যস্ফীতি-

  • মজুরির মূল্য বৃদ্ধি-

  • অর্থ সরবরাহের অতিরিক্ত সম্প্রসারণ-

সুতরাং গ্রাহকদের যখন আয় বৃদ্ধি পায় ব্যয়যোগ্য অর্থের আধিক্যের ফলে তাদের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি ঘটে। মানুষের হাতে ব্যয় করার মত অতিরিক্ত অর্থ আসলে মানুষ আরও পণ্য/সেবা ক্রয় করতে চায় এবং তাদের সেই ক্ষমতাও থাকে। সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব ও আর্থিক নীতি, উপভোক্তার জন্য ভবিষ্যতে মূল্য বৃদ্ধির প্রত্যাশা এবং বাজারের বিপনন ব্যবস্থা তথা পণ্যকে চিহ্নিতকরণ পদ্ধতির চাহিদা বাড়িয়ে তুলতে পারে। যখন বাজারে পর্যাপ্ত চাহিদা সৃষ্টি হয় এবং তার সাথে যৌথভাবে পণ্যের সরবরাহের প্রভূত ঘাটতি দেখা দেয় তখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে প্রস্তুতকারক/সরবরাহকারীর জন্য মূল্য বাড়ানোর একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়।

মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতির কারণ 

মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতির কারণ

  • মজুরির মূল্য বৃদ্ধি বা বেতন বৃদ্ধি –

  • একচেটিয়া বাজার তৈরির ক্ষমতা –

  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ –

  • ক্রমাগত প্রাকৃতিক সম্পদের হ্রাস-

  • সরকারী নিয়ন্ত্রণ এবং কর –

  • তাছাড়া কোন দেশ যখন তার মুদ্রার বিনিময় হার কমায় তখন তা আমদানিতে মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়। তখন স্থানীয় মুদ্রার মান কম থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম থাকলেও স্থানীয় মুদ্রায় আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেশি পড়ে। একই সাথে আমদানি নিরুৎসাহিত হয়। ফলে বাজারে ওই পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানীতে স্থানীয় মুদ্রায় বেশি খরচ পড়ে। উৎপাদনকারীরা তাদের পণ্য বা পরিষেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে দাম বাড়ায়। এছাড়াও মজুরি বৃদ্ধি, একচেটিয়া মূল্য নির্ধারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সরকারি বিধি বিধান, মুদ্রা বিনিময় হার প্রায়শই চাহিদার তুলনায় সরবরাহ হ্রাস করে।

আরও পড়ুন: মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচনের পার্থক্য