ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক সম্পর্কে আলোচনার আগে অর্থনীতিতে ভোগ বলতে কি বুঝায় তা জানা দরকার।
প্রাচ্য দর্শনে ভোগকে একটি নেতিবাচক অভিধা হিসাবে বিবেচনা করা হলেও পাশ্চাত্য দর্শনে ভোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাশ্চাত্য দর্শনকে আমরা বলি ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা। ভোগবাদীদের মতে ভোগের মাধ্যমে মানুষের অভাব পূরণের সন্তুষ্টি মেলে।
অর্থনীতি শাস্ত্রে ভোগ তথা ভোগ ব্যয়ের ধনাত্মক দ্যোতনা রয়েছে। ভোগ না থাকলে অর্থনীতির চাকা অচল। তাই আধুনিক অর্থনীতিতে ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক পাঠ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।
ভোগ কি?
সাধারণ অর্থে ভোগ বলতে কোন দ্রব্যের উপযোগের সবটুকু নিঃশেষ করাকে বুঝায়। আবার অন্যভাবে বলা যায়, কোন দ্রব্য বা সেবা থেকে উপযোগ প্রাপ্তিকে ভোগ বলে। এগুলি কেতাবি ভাষা। আমি সহজভাবে যেটা বুঝি সেটা হল- আমি একটা জিনিস ১০ টাকা দিয়ে কিনলাম, আমার কাছে তার মূল্য বা উপযোগ ১০ টাকা, এটি আমি ব্যবহার করতে থাকলাম, এক সময় আমার কাছে এটি আর ব্যবহার উপযোগী মনে হল না, তার মূল্য তখন আমার কাছে শূন্য অর্থাৎ জিনিসটি আমি সম্পূর্ণরূপে ভোগ করেছি, এখন আমার কাছে তার আর কোন উপযোগ নেই।
উপযোগ বা ব্যবহারযোগ্যতা নিঃশেষ হলেই সব সময় ভোগ হয় না। যেমন, রাগ করে হাতের গ্লাসটি (১০ টাকা দাম) আছাড় মেরে ভেঙে ফেললাম; এখন এটি আর ব্যবহারযোগ্য রইল না, এটির মূল্য তখন শূন্য। এভাবে ব্যবহারযোগ্যতা হারানো বা মূল্যহীন হওয়ার প্রক্রিয়া ভোগ নয়। বরং গ্লাসটি আমি ব্যবহার করতে করতে এক সময় মনে হল এটি আর ব্যবহার করতে ভালো লাগছে না, আর ব্যবহার করব না। গ্লাসটি অক্ষত থাকলেও আমার কাছে তার উপযোগ নিঃশেষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ জিনিসটি আমি ভোগ করেছি। অর্থাৎ উদ্দেশ্য বিহীনভাবে কোন দ্রব্যের উপযোগ নিঃশেষ করাকে ভোগ বলা যাবে না।
এক বা একাধিক উদ্দেশ্যে স্বাভাবিক ব্যবহারের মাধ্যমে কোন দ্রব্যের বা সেবার উপযোগ নিঃশেষ করাকে ভোগ বলা হয়।
এটিকেই অর্থনীতিবিদ Meyers বলেছেন, “স্বাধীন মানুষের অভাবের তৃপ্তি সাধনের জন্য দ্রব্য ও সেবাকর্মের প্রত্যক্ষ ও চূড়ান্ত ব্যবহার হল ভোগ।“
সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভোগ বলতে সামগ্রীক ভোগ বুঝানো হয়। কোন ব্যক্তি বিশেষের ভোগ বুঝায় না। একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন দেশের সকল নাগরিক কর্তৃক যে ভোগ হয় তার সমষ্টি হচ্ছে সামগ্রীক ভোগ।
ভোগ হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক। অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত থাকলে ভোগ সরাসরি আয়ের উপর নির্ভর করে। ভোগ বাড়লে দেশের কার্যকর চাহিদা বাড়ে। আর বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদন ও সেজন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হয়। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে। হ্যাঁ, ভোগের ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে। এই পয়েন্টে এসে ভোগবাদের বিরোধীরাও সুর নরম করেন।
যেহেতু অর্থনীতির আলাপ হচ্ছে, সেহেতু বলতেই হয় যে, ভোগের জন্য যে ব্যয় হয় তাকে ভোগ ব্যয় বলে।
ব্যয়যোগ্য আয় থেকে সঞ্চয় বাদ দিলে পাওয়া যায় ভোগ ব্যয়।
যে সমস্ত উপাদান দ্বারা ভোগ ব্যয় প্রভাবিত হয় সেগুলিকে ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক বলা হয়।
ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক
Determinants of Consumption Expenditure
ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক অনেক।
মানুষের ভোগ ব্যয় বস্তুগত, অবস্তুগত, অর্থনৈতিক, অ-অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি বহু উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। এগুলিকে বলা হয় ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক। নিচে ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক সমুহ আলোচনা করা হল।
১। আয়ঃ
ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক গুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে আয়। আমরা সবাই জানি বা বুঝি যে, আয় বাড়লে ভোগ বাড়ে এবং আয় কমলে ভোগ কমে। জাতীয় আয় বাড়লে সামগ্রীক ভোগ বাড়ে। অর্থাৎ, আয়ের উপর ভোগ ব্যয় নির্ভর করে।
২। মজুরিস্তরঃ
মজুরিস্তরের উপর ভোগ ব্যয় অনেকাংশে নির্ভরশীল। কেননা, মজুরিস্তর বেশি হলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেশি হয়, মানুষ বেশে ভোগ করে এবং ভোগ ব্যয় বেশি হয়। অন্যদিকে, মজুরিস্তর কম হলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কম হয় এবং ভোগ ব্যয়ও কম হয়।
৩। মূল্যস্তরঃ
মুল্যস্তরের উপর ভোগ ব্যয় নির্ভর করে। মুল্যস্তর বাড়লে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় এবং ভোগও কমে যায়। মুল্যস্তর কমলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং ভোগও বেড়ে যায়।
মূল্যস্তর বাড়লে প্রকৃত ভোগ কমলেও ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
৪। নগদ অর্থ বা তারল্যঃ
নগদ অর্থ বা সম্পদের উপর ভোগ ব্যয় নির্ভর করে। মানুষের হাতে নগদ অর্থ বেশি থাকলে ভোগ ব্যয় বেশি হবে। আর যদি নগদ অর্থের পরিবর্তে স্থায়ী সম্পদ বেশি থাকে তাহলে ভোগ ব্যয় কমে যাবে। কারণ, নগদ অর্থ দিয়ে ইচ্ছামত যে কোন সময় ভোগ করা যায়, কিন্তু স্থায়ী সম্পদ নগদ অর্থের মত যে কোন সময় ব্যবহার বা ব্যয় করা যায় না।
৫। সঞ্চয় প্রবনতাঃ
সঞ্চয় প্রবনতা দ্বারা মানুষের ভোগ প্রবনতা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। যদি মানুষের সঞ্চয় প্রবনতা বেশি হয় তবে ভোগ করার জন্য কম অর্থ থাকে। সঞ্চয় প্রবনতা কম হলে ভোগ প্রবনতা বেশি হয়। কারন, ব্যয়যোগ্য আয়ের একটি অংশ মানুষ ভোগ করে বাকি অংশ সঞ্চয় করে। তাই সঞ্চয় প্রবনতা গুরুত্বপূর্ণ ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক।
৬। আয়ের বন্টনঃ
জাতীয় আয়ের উপর একটি দেশের সামগ্রীক ভোগ ব্যয় নির্ভর করে। যদি জাতীয় আয়ের বন্টন সুষম হয় তবে সমাজের সকল মানুষের হাতে টাকা থাকে, সবাই দ্রব্যসামগ্রী কিনতে সক্ষম হয়, ফলে সমাজের সামগ্রীক ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে, আয়ের বন্টন অসম হলে আয়ের বেশিরভাগ মালিকানা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে থাকায় অধিকাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। ফলে সমাজের সামগ্রীক ভোগ ব্যয় কমে যায়।
৭। করের হারঃ
কর হার দ্বারা মানুষের ভোগ প্রবনতা প্রভাবিত হয়। কেননা, করের হার বেশি হলে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় কমে যায়। এর ফলে ভোগস্তর কমে যায়। অন্যদিকে, কর কম হলে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় বাড়ে এবং ভোগ ব্যয় বাড়ে।
৮। প্রদর্শন প্রভাব বা অনুকরণ প্রিয়তাঃ
মানুষ সামাজিক জীব। তাই অন্যান্য মানুষের ভোগ অভ্যাস দ্বারা ভোক্তার ভোগব্যয় প্রভাবিত হয়। যাদের প্রতিবেশি ধনী তাদের আয় কম হলেও ভোগ বেশি হয়। কারণ, ধনী ব্যক্তির দেখা দেখি তারাও অনেক কিছু ভোগ করার তাগিদ অনুভব করে। এভাবে অন্যান্য মানুষের ভোগ আচরণ দ্বারা ভোক্তার ভোগব্যয় প্রভাবিত হওয়াকে বলে প্রদর্শন প্রবনতা।
৯। Ratchet প্রভাবঃ
কথায় আছে – নদী মরে গেলেও রেখা থেকে যায়। তেমনি ধনী লোক গরীব হলেও বড়লোকী চাল রয়ে যায়। মানুষের আয় হঠাৎ কমে গেলে সে তার খরচ আনুপাতিক হারে কমাতে পারে না।
নিকট অতীতের সর্বোচ্চ আয়স্তরের ভোগ অভ্যাস দ্বারা ভোক্তার বর্তমান ভোগ প্রভাবিত হওয়াকে বলা হয় Ratchet প্রভাব। Ratchet প্রভাবের কারণে ভোক্তা তার নিকট অতীতের সর্বোচ্চ আয় স্তরের ভোগ অভ্যাস সহজে ত্যাগ করতে পারে না। তাই হঠাৎ কোন কারণে তার আয় কমে গেলেও ভোগ ব্যয় আয়ের তুলনায় বেশি রয়ে যায়।
১০। সামাজিক নিরাপত্তাঃ
বিভিন্ন প্রকার হস্তান্তর পাওনা যেমন বয়স্ক ভাতা, বেকার ভাতা, দুস্থ মহিলা ভাতা, পেনশন, প্রতিবন্ধী ভাতা- সরকার কর্তৃক প্রদত্ত এসব ভাতাকে বলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচি।
যে সকল দেশে এরূপ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচি রয়েছে সেসব দেশের জনগণ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরাপদ বোধ করে, তাই বর্তমানে তারা ভোগে বেশি ব্যয় করে। আর যে সকল দেশে এরূপ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচি নাই বা দুর্বল সেসব দেশের জনগণ বর্তমানে ভোগে কম ব্যয় করে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বেশি সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হয়। এভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচি দ্বারা ভোগ ব্যয় প্রভাবিত হয়।
১১। সুদের হারঃ
ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক গুলির মধ্যে সুদের হার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুদের হার দ্বারা মানুষের ভোগ ব্যয় প্রভাবিত হয়। সুদের হার বেশি হলে মানুষ অধিক পরিমানে সঞ্চয় প্রবন হয়ে পড়ে এবং ভোগ কম করে। অন্যদিকে, সুদের হার কম হলে মানুষ সঞ্চয়ে নিরুৎসাহিত হয়। ফলে ভোগ ব্যয় বেশি হয়।
১২। রুচি এবং অভ্যাসঃ
রুচি এবং অভ্যাস দ্বারা ভোগ প্রবনতা প্রভাবিত হতে পারে। মানুষের অভ্যাস ও রুচি উন্নত হলে ভোগ ব্যয় বেশি হয়। অনুন্নত রুচি ও অভ্যাস মানুষের ভোগ ব্যয় হ্রাস করে।তাই রুচি বা অভ্যাসকেও ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক হিসাবে গন্য করা হয়।
১৩। ভবিষ্যৎ প্রত্যাশাঃ
ভবিষ্যতে দাম বৃদ্ধি পেতে পারে বা আয় বৃদ্ধি পেতে পারে এরূপ পূর্বাভাসে বর্তমান দামেই ভোগ ব্যয় বেড়ে যায়। পক্ষান্তরে, ভবিষ্যতে দাম কমতে পারে বা আয় কমে যেতে পারে এরূপ পূর্বাভাসে বর্তমান দামেই ভোগ ব্যয় কমে যায়।
১৪। বিজ্ঞাপনঃ
গতকাল যা চিনতেন না আজ মনে হচ্ছে তা ছাড়া জীবন চলবে না। এটি হচ্ছে বিজ্ঞাপনের কারিশমা।
বিজ্ঞাপন মানুষকে ভোগে উৎসাহিত করে। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন পণ্যের স্বাদ, গুণ, মান, দাম, প্রাপ্তিস্থান ইত্যাদি জানতে পারে। ফলে বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই পণ্যটি ভোগের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
(দামে কম, মানে ভালো, কাকলী ফার্নিচার!)
১৫। স্থান, কাল, পাত্রঃ
স্থানভেদে মানুষের ভোগ ব্যয় কম বেশি হতে পারে। যেমন- গ্রামের মানুষের তুলনায় শহরের মানুষের ভোগ ব্যয় বেশি। গ্রীষ্মকালে সূতির কাপড়, ফ্রিজ, ঠান্ডা পানীয়, আইসক্রীম ইত্যাদির ভোগ বেড়ে যায়। শীতকালে গরম কাপড়ের চাহিদা বাড়ে। পাত্রভেদে আবার ভোগ ব্যয় ভিন্ন হতে পারে। যেমন- একজন শিক্ষক বা চাকুরিজীবির ভোগ্য পণ্যের তালিকা একজন শ্রমিক বা কৃষকের ভোগ্য পণ্যের তালিকা থেকে ভিন্ন হবে; ভোগ ব্যয়ও ভিন্ন হবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলি বা উপাদানগুলি সাধারণত কোন দেশের মানুষের ভোগ ব্যয়কে প্রভাবিত করে। তাই এগুলিকে ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক বা ভোগ প্রবনতার নিয়ামক বলে। এগুলি ছাড়াও আরো অনেক ভোগ ব্যয়ের নির্ধারক থাকতে পারে।
আরও পড়ুন: ভোক্তার আচরণ
Leave A Comment