ভেড়া পালনের গুরুত্ব

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ভেড়া পালন জনপ্রিয়। মাংস, উল ও দুধ উৎপাদনের জন্য ভেড়া পালন হয়ে থাকে। বড় বড় বাণিজ্যিক খামারের মাধ্যমে ভেড়া পালন সম্ভব। তাছাড়া পারিবারিক পযার্য়েও ভেড়া পালন সম্ভব। ভেড়ার মাংস অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু।

 

ভেড়া পালনের বিশেষ দিক

ভেড়া শান্ত ও ছোট প্রাণী। ফলে ভেড়ার খাদ্যআবাসন জনিত বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি কম।

ভেড়া মাংস, পশম, চামড়া ও জৈব সার উৎপাদন করে।

ভেড়া গরু ছাগলের সংগে মিশ্রভাবে পালন করা যায়।

একটি ভেড়া সাধারণত বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। প্রতিবার গড়ে ২ টি করে বাচ্চা দেয়।

পালনের জন্য ৭ — ১২ মাস বয়সী সুস্থ ভেড়া নিবার্চন করা উচিত।

শারীরিক গঠনের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ২ ধরনের ভেড়া দেখা যায়। যথাঃ

একটি জাতের কান খুব ছোট ও লেজ খাট। ভঅন্যটির কান মোটামুটি বড় ও লেজ মধ্যম আকৃতির।

ভেড়া খুব কষ্টসহিষ্ণু এবং এদের অসুখ বিসুখ খুব কম হয়।

ভেড়ার মাংসের পুষ্টিগুণ

ভেড়ার মাংসে বিভিন্ন রকমের খনিজ লবন রয়েছে। ৪ আউন্স (১১৪ গ্রাম) ভেড়ার মাংস গ্রহণ করলে খনিজ লবনের প্রতিদিনের চাহিদার ৩৩% পূরণ হয়ে থাকে।

ভেড়ার মাংস প্রচুর পরিমাণে জিংক থাকে। জিংক শরীরের ক্ষত নিরাময় এবং টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভেড়ার মাংস আয়রন ও কপারের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। ৪ আউন্স (১১৪ গ্রাম) ভেড়ার মাংস গ্রহণ করলে আয়রনে প্রতিদিনের চাহিদার ১২% এবং কপারের ৭% পূরণ হয়ে থাকে। লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদনে আয়রন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কপার শরীরে আয়রন বিপাকে এবং লোহিত রক্তকণিকা বিশ্লেষণে সাহায্য করে।

ভেড়ার মাংস গ্রহণ করলে রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। ভেড়ার মাংসে কাবোর্হাইড্রেটের উপস্থিতি থাকে না এবং এর ফলে গ্লাইসেমিক সূচক মাত্রা খুব কম থাকে।

ভেড়ার মাংস প্রোটিনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। ৪ আউন্স (১১৪ গ্রাম) ভেড়ার মাংসে ২৭.৫ গ্রাম প্রোটিন রয়েছে যা দ্বারা আমাদের শররের প্রতিদিনের প্রোটিন চাহিদার ৫৫% পূরণ হয়ে থাকে।

ভেড়ার মাংসে ওমেগা—৩ ফ্যাটি এসিড থাকে। ওমেগা—৩ যখন ওমেগা—৬ এ উন্নীত বা পরিবতীর্ত হয় তা কার্ডিও ভাস্কুলার ডিজিজ এর ঝুঁকি কমায়।

ভেড়ার মাংসে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন বি—১২ এবং নিয়াসিন রয়েছে।

ভেড়ার জাত পরিচিতি

সারা বিশ্বে প্রায় ৯০০ জাতের ভেড়া পাওয়া যায়।

দুধ, মাংস ও উল উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে ভেড়াকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

  1.  মাংস ও অধিক বাচ্চা উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত;
  2. উল ও মাংস উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত;
  3. দুধ উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত।

মাংস ও অধিক বাচ্চা উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত

অধিক মাংস উৎপাদনকারী ভেড়ার জাতসমূহ সাধারণত শীত প্রধান দেশে দেখা যায়। তবে কিছু মাংস উৎপাদনশীল ভেড়ার জাত মরু অঞ্চলেও দেখা যায়।

সাফ্ক, ডরসেট, হ্যাম্পসায়ার ইত্যাদি অধিক মাংস উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত। প্রাপ্ত বয়স্ক এ সকল ভেড়ার ওজন ৯০—১৩৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।

ভেড়ার জাত

সাফ্ক ভেড়া

ডরসেট জাতের ভেড়া

হ্যাম্পসায়ার জাতের ভেড়া

উল ও মাংস উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত

মেরিনো, চিভয়েট, ব্লু ডু মেইন, লিংকন জাতের ভেড়া অধিক উল ও মাংস উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত। এরা প্রতি বছরে ২—৬ কেজি পর্যন্ত উল উৎপাদন করতে পারে।

 

দুধ উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত

আওয়াসী, ইস্ট ফ্রিজিয়ান ভেড়া দুধ উৎপাদনকারী ভেড়ার জাত। এরা বছরে ২১০ দিনে ৩৫০—৭৫০ লিটার পর্যন্ত দুধ উৎপাদনে সক্ষম।

 বাংলাদেশে প্রাপ্ত ভেড়া

বাংলাদেশে প্রাপ্ত ভেড়াসমূহ জাত হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও এদের বিশেষ স্বকীয়তা রয়েছে।

অঞ্চল ভেদে বাংলাদেশে মোট তিন ধরনের ভেড়া পাওয়া যায়। যথাঃ

বরেন্দ্র অঞ্চলের ভেড়া

যমুনা অববাহিকার ভেড়া

উপকূলীয় অঞ্চলের ভেড়া

 

বরেন্দ্র অঞ্চলের ভেড়া

রাজশাহী, চাপাঁইনবাবগঞ্জ ও নাটোর এলাকায় এ ধরনের ভেড়া পাওয়া যায়।

এদের কান ছোট, লেজ সরু ও ছোট, পেট ও পায়ে উল নেই। ভেড়া শিং যুক্ত কিন্তু ভেড়ী শিং বিহীন।

প্রাপ্ত বয়স্ক ভেড়ার ২২—৩০ কেজি এবং ভেড়ি ১৫—২৫ কেজি ওজন বিশিষ্ট হতে দেখা যায়।

এরা অত্যন্ত প্রজননক্ষম, সাধারনত ৫—৬ মাস বয়সেই প্রজননক্ষম হয়।

বছরে ২ বার বাচ্চা প্রদান করে এবং প্রতিবারই ১—৩ টি পর্যন্ত বাচ্চা উৎপাদন করতে পারে।

যমুনা অববাহিকার ভেড়া 

টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, বগুড়া, গাইবান্ধাসহ যমুনা অববাহিকায় এধরনের ভেড়া পাওয়া যায়।

এদের কান ছোট, লেজ তুলনামুলকভাবে একটু লম্বাটে। পেট ও পায়ে উল নেই। ভেড়া পেচানো শিং যুক্ত কিন্তু ভেড়ী শিং বিহীন।

প্রাপ্ত বয়স্ক ভেড়ার ১৮—২৫ কেজি এবং ভেড়ি ১৫—২২ কেজি ওজন বিশিষ্ট হতে দেখা যায়।

এরা অত্যন্ত প্রজননক্ষম, সাধারনত ৫—৬ মাস বয়সেই প্রজননক্ষম হয়।

বছরে ২ বার বাচ্চা প্রদান করে এবং প্রতিবারই ২—৩ টি পর্যন্ত বাচ্চা উৎপাদন করতে পারে।

উপকূলীয় অঞ্চলের ভেড়া

বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের চরাঞ্চলে যেমন নোয়াখালী, পটুয়াখালী, ভোলা, হাতিয়া, লক্ষীপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ ধরনের ভেড়া পাওয়া যায়।

এরা লবণাক্ত স্যাঁত — স্যাঁতে চারণভূমিতে চরে খেতে অভ্যস্ত।

এদের শিং পিছনে বাঁকানো কিন্তু পেচানো নয়।

এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও সুন্দরবন এলাকার পার্শবর্তী এলাকায় গারল নামে একধরনের ভেড়া পাওয়া যায়।

এদের লেজ তুলনামূলকভাবে লম্বা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী।

আরও পড়তে পারেন: ছাগলের জাত পরিচিতি

ভেড়ার খামারের আয়—ব্যয়ের হিসাব

আমাদের দেশে ভেড়ার খামারের আয়-ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব পাওয়া যায় না। বানিজ্যিক ভেড়ার খামার এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত না। তবে এটা বলা যায় ভেড়ার বানিজ্যিক খামার একটি সম্ভাবনাময় খাত।

ভেড়া হতে উল উৎপাদন

বাংলাদেশে সাধারণত মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে ভেড়া পালন করা হয়ে থাকে। তবে ভেড়া থেকে কিছু পরিমান উল উৎপাদিত হয়ে থাকে। এসকল উল সাধারণত গুণগত দিক থেকে নিম্নমানের। উৎপাদিত উল সাধারণত কার্পেট, কম্বল ও মাদুর তৈরীতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বছরে ২—৩ বার শেয়ারিং এর মাধ্যমে উল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত হস্তচালিত ব্লেড দিয়ে শেয়ারিং এর কাজ সম্পন্ন করা হয় তবে ইলেক্ট্রিক্যাল শেয়ারার ব্যবহার অধিক নিরাপদ। উল সংগ্রহ করার পূর্বে কিছু প্রস্তুতিমূলক বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখতে হবে। যথাঃ

  • উল সংগ্রহের পূর্বে ভেড়াকে ভালভাবে গোসল করিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
  • উল/পশম যাতে ভিজা না থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
  • শেয়ারিং করা স্থানের মেঝে অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, শুকনো ও পাঁকা হতে হবে।
  • শেয়ারিং এর সময় ভেড়ার চার পা সঠিকভাবে বেধে নিতে হবে অথবা ভেড়া দাড়ানো অবস্থার যথেষ্ট আয়ত্বের মধ্যে রেখে শেয়ারিং সম্পন্ন করতে হবে।

সেমি—ইনটেনসিভ পদ্ধতিতে ৩০ টি ভেড়া বিশিষ্ট খামার এর সম্ভাব্য আয়—ব্যয়ের হিসাবঃ

খরচের খাতটাকার পরিমাণ
প্রয়োজনীয় মূলধন বিণিয়োগঃ
প্রয়োজনীয় জমিনিজস্ব
ছন ও বাঁশের তৈরী ঘর২০০০০
৩০ টি গর্ভবতী ভেড়া ও ৩ টি ভেড়ার মূল্য @৫০০০/—১৬৫০০০
খাবার পাত্র, পানির পাত্র ও অন্যান্য৪০০০
বিনিয়োগকৃত মূলধন১৮৯০০০
১ম বছরের আবর্তক ব্যয়
প্রতিটি ভেড়ার প্রতিদিনের দানাদার খাবার ০.২৫ কেজি হারে ৩৬৫ দিনে মোট দানাদার খাদ্য লাগবে ০.২৫X৩৬৫=৯১.২৫ কেজি। সুতরাং প্রতিকেজি ৪০ টাকা হারে ৩৩ টি ভেড়ার দানাদার খাদ্য বাবদ খরচ হবে ৯১.২৫ X ৩৩ X  ৪০=১২০৪৫০.০০১২০৪৫০
প্রতিটি ভেড়ার দৈনিক ২ কেজি কাঁচা ঘাস হিসেবে ৩৩ টি ভেড়ার ৩৬৫ দিনে খরচ বাবদ @ ২ টাকা/কেজি৪৮১৮০
৬০ বাড়ন্ত ভেড়ার ১৮০ দিনের দানাদার খাদ্য খরচ @০.১৫ কেজি/ভেড়া৬৪৮০০
৬০ বাড়ন্ত ভেড়ার ১৮০ দিনের কাঁচা ঘাস বাবদ খরচ ১ কেজি/ভেড়া২১৬০০
আনুষাঙ্গিক ও ঔষধ বাবদ খরচ৫০০০
১ম বছরের মোট আবর্তক ব্যয়২৬০০৩০
১ম বছরের মোট আয়
৬০ ভেড়া বিক্রয় বাবদ @৫০০০/—৩০০০০০
বিষ্টা বিক্রয়১০০০০
মোট আয়৩১০০০০
নীট খরচ (আবর্তক ব্যয়+মূলধন ব্যয়ের এক দশমাংশ) (একবার মূলধন ব্যয় দিয়ে ১০ টি ব্যাচ প্রতিপালন করা যাবে) (২৬০০৩০.০০+১৮৯০০.০০=২৭৮৯৩০০.০০/—)২৭৮৯৩০
১ম বছরের নীট মুনাফা ( মোট আয়—নীট খরচ)৩১০৭০
পরবর্তী বছর হতে ১ম বছরের নীট মুনাফার কয়েকগুন হিসাবে নীট মুনাফা অর্জিত হবে।