জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব

জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা 

Importance of National Income Accounting

কোন নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছরে) একটি দেশের জনগণ তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রম, মেধা সম্পদ (শিক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি) ও মূলধনের সাহায্যে যে পরিমান চূড়ান্ত দ্রব্যসামগ্রি ও বিভিন্ন প্রকার সেবাকর্ম উৎপাদন করে তার আর্থিক মূল্যকে বলা হয় জাতীয় আয়। জাতীয় আয়ের পরিমান থেকে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে সম্যক ধারনা পাওয়া যায়। কারণ, উৎপাদিত  চূড়ান্ত দ্রব্যসামগ্রি ও সেবা উপভোগের উপরেই জনগনের জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে। তাই কোন জাতির জীবনযাত্রার মান নিরুপনে জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

তা ছাড়া অর্থনীতির তত্ত্বীয় বিশ্লেষণেও জাতীয় আয়ের ধারণাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাই এক্ষেত্রেও জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব রয়েছে।

নিম্নে জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব আলোচনা করা হল-

১। অর্থনৈতিক অবস্থার মানদন্ডঃ জাতীয় আয়কে ধরা হয় অর্থনৈতিক অবস্থার মাপকাঠি। দেশের অর্থনীতি যত ভালভাবে চলবে উৎপাদন তত বৃদ্ধি পাবে এবং জাতীয় আয়ের পরিমান তত বেশি হবে। অর্থাৎ, জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলে বুঝা যাবে যে উৎপাদন বেড়েছে এবং দেশের অর্থনীতি ভালভাবে চলছে। কাজেই, কোন দেশের অর্থনীতি সঠিকভাবে চলছে কিনা তা সে দেশের জাতীয় আয়ের হিসাব থেকেই বুঝা যায়। তাই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ P A Samuelson যথার্থই বলেছেন যে, “জাতীয় আয় হচ্ছে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার মাপকাঠি।”

২। জীবনযাত্রার মান নির্ধারকঃ জাতীয় আয়ের হিসাব থেকে জনগণের জীবনযাত্রার মান, জনগণের মাথাপিছু আয় ও তাদের ক্রয়ক্ষমতা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। কারণ, জাতীয় আয় বাড়লে মাথাপিছু আয় ও ব্যয়যোগ্য আয় বাড়ে, অর্থাৎ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে; সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মানও বাড়ে। দেশের প্রকৃত জাতীয় আয় যত বাড়বে দেশবাসীর জীবনযাত্রার মানও তত উন্নত হবে।

জীবন যাত্রার মান

৩। বিভিন্ন খাতের তুলনামূলক গুরুত্ব নির্ণয়ঃ কৃষি, শিল্প, সেবা ইত্যাদি খাতের উৎপাদন মিলিয়ে হয় জাতীয় উৎপাদন। দেশের জাতীয় আয়ে কৃষি, শিল্প, সেবা ইত্যাদি বিভিন্ন খাতের অবদান কতটুকু তা থেকে অর্থনীতিতে খাতগুলির অবদান নির্ণয় করা যায়। অর্থনীতির কোন খাতে কতটুকু উন্নতি হচ্ছে, কোন খাতে আরও উন্নতি হওয়া দরকার বা সুযোগ রয়েছে তাও জাতীয় আয়ের হিসাব থেকে জানা যায়।

৪। অর্থনৈতিক তথ্যের উৎসঃ জাতীয় আয়ের হিসাবকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক তথ্যের উৎস হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কোন দেশের ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জাতীয় আয়ের হিসাব থেকে পাওয়া যায়। তাই অর্থনৈতিক তথ্যের উৎস হিসাবে জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

দেশের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত সমস্ত পণ্য ও সেবার বাজারমূল্য = ঐ সময়ে দেশের অভ্যন্তরে জনগণের ভোগ করা সমস্ত পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্য + বিনিয়োগ + সরকারি ব্যয় + রপ্তানিকৃত পণ্যের মোট বাজারমূল্য – আমদানিকৃত পণ্যের মোট বাজারমূল্য।

৫। সম্পদের বন্টনঃ দেশের সম্পদের বন্টন ব্যবস্থা কিরূপ তা জাতীয় আয়ের হিসাব করার সময় ধরা পড়ে এবং তার ভিত্তিতে সরকারী নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় যাতে সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে জমা না হয়ে আপামর জনগণের মাঝে বন্টিত হয়। যেমন, আয়করের উপর সিলিং, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বা হস্তান্তর পাওনা, ভর্তুকি ইত্যাদি। সম্পদের সুষম বন্টনেও জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

৬। ব্যবসায় বানিজ্যের গতি সম্পর্কে ধারণাঃ দেশের জাতীয় আয়ের পর্যালোচনা না করে ব্যবসায় বানিজ্যের গতি সম্পর্কে পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। কারণ, জাতীয় আয়ের হিসাব থেকেই ব্যাবসায় বানিজ্যের গতি আন্দাজ করা যায়।

৭। বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনাঃ বিভিন্ন দেশের জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান থেকে কোন দেশের জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় এবং জীবনযাত্রার মান বুঝা যায়। যেমন- বাংলাদেশ ও জাপানের জাতীয় আয় তুলনা করলে বুঝা যায় যে, বাংলাদেশ হতে জাপান কতটা সমৃদ্ধশালী এবং সে দেশের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশ থেকে কতটা উন্নত।

২০১৯ সালে জাপানের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় ৪১৫৮০ ইউএস ডলার পক্ষান্তরে ওই সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় ছিল ১৯৪০ ইউএস ডলার।

৮। অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার নির্দেশকঃ বর্তমানের সাথে অতীতের কয়েক বছরের জাতীয় আয়ের তুলনা করলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার জানা যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার বাড়ছে না কমছে নাকি অপরিবর্তিত আছে তা আমরা জাতীয় আয়ের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি। অর্থাৎ, জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান দেখে আমরা অর্থনীতির উন্নতি বা অবনতি বুঝতে পারি।

 

২০২০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় (GNI) ৩৩০.৬৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার,  প্রবৃদ্ধির হার ৪.৫৫%

২০১৯ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় (GNI) ৩১৬.২৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার,  প্রবৃদ্ধির হার ৮.২৯%

২০১৮ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় (GNI) ২৮২.০৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার,  প্রবৃদ্ধির হার ৮.১২%

২০১৭ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় (GNI) ২৪২.৭৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার,  প্রবৃদ্ধির হার ৫.৮৮%

২০১৬ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় (GNI) ২১৬.২৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার,  প্রবৃদ্ধির হার ৬.৪১%

 

৯। মুদ্রাস্ফীতি কিংবা মুদ্রাসংকোচনের তীব্রতা পরিমাপঃ জাতীয় আয়ের পরিমান হতে মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাসংকোচনের তীব্রতা অনুমান করা যায়।  কোন দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও উৎপাদিত দ্রব্যের দামের হ্রাস-বৃদ্ধি পরিমাপের জন্য জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব অপরিসীম।

১০। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নঃ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বে দেশের অর্থনীতির গতি বিশ্লেষণ করা দরকার হয়। আর এজন্য জাতীয় আয়ের অতীত ও বর্তমান অবস্থার আলোকে পরিকল্পনাবিদগণ ভবিষ্যতের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকেন। তাই এক্ষেত্রে জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব রয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়নকালে দেশের মোট জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, ভোগ ও বিনিয়োগের পরিমান, উৎপাদনের হার, জাতীয় অর্থনীতিতে বিভিন্ন খাতের অবদান, ইত্যাদি তথ্যের প্রয়োজন হয়। এসব তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎস হল জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান। তাই, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

১১। আন্তর্জাতিক সংস্থার চাঁদার হার নিরুপনঃ জাতীয় আয়ের পরিমানের উপর উপর নির্ভর করে জাতিসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, চন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমুহের চাঁদার হার নিরুপন করা হয়। বিভিন্ন দেশের জাতীয় আয়ের উপর নির্ভর করে সে সব দেশের চাঁদা প্রদানের সক্ষমতা। আর সেই সক্ষমতা বিবেচনা করেই চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয়।

১২। বাজেট প্রণয়নঃ একটি দেশের সরকারের মূল অর্থনৈতিক কর্ম হল বাজেট প্রণয়ন। সরকারের বাৎসরিক বাজেট প্রণয়নে জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, বাজেট হল সরকারের এক বছরের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলন। সুতরাং সরকারের বিভিন্ন উৎস হতে সম্ভাব্য আয় এবং বিভিন্ন খাতে সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণে জাতীয় আয় পর্যালোচনা অত্যন্ত জরুরি এবং জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৩। দেশের অর্থনৈতিক কল্যানের মাপকাঠিঃ জাতীয় আয়ের পরিমান দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক কল্যাণের স্তর অনুধাবন করা যায়। অন্যান্য় শর্ত অপরিবর্তিত থাকলে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধিতে দেশের অর্থনৈতিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায় এবং জাতীয় আয় হ্রাস পেলে অর্থনৈতিক কল্যাণও হ্রাস পায়।

উপরে সংক্ষিপ্তাকারে যে আলোচনা করা হল তা থেকে বলা যায়, জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যানে একটি দেশের অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটে উঠে। এতে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাসমুহ যেমন চিহ্নিত হয় তেমনি সে সমস্যাসমুহ সমাধানের ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান হতে একটি দেশের অর্থনীতির সঠিক অবস্থা মূল্যায়ন করা যায়। কারণ এতে বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। দেশের কৃষিজাত ও শিল্পজাত উৎপাদন, ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, মূলধন গঠন ইত্যাদি কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তা জাতীয় আয়ের বিভিন্ন বছরের হিসাব থেকে জানা যায়। এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যথোপযোক্ত নীতি গ্রহণ করতে পারে।

এক কথায়, জাতীয় আয় হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির আয়না স্বরূপ। আয়নায় যেমন প্রতিবিম্ব দেখা যায়, জাতীয় আয়ের মাধ্যমেও একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রতিফলিত হয়। তাই জাতীয় আয় পরিমাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন: ভারসাম্য জাতীয় আয়