Table of Contents
গরুর ইউরিয়া পয়জনিং
(Urea Poisoning in Cattle)
গরুর জন্য ইউরিয়া একটি মারাত্মক বিষ। গরুকে সরাসরি ইউরিয়া খাওয়ালে বা ইউরিয়া মিশ্রিত পানি খাওয়ালে গরুর ইউরিয়া পয়জনিং দেখা দেয়। অনেকে ভুল বসত জমিতে ইউরিয়া দেবার পর সারের বস্তাটি গরুর খাবার বা পানির পাত্রে ধুয়ে সেই পানি গরুকে খেতে দেন। আবার গ্রামে অনেক সময় যে জমিতে মাত্র ইউরিয়া সার দেয়া হয়েছে সেই জমির পানি গরু পান করেও গরুর ইউরিয়া পয়জনিং হয়। খাবার পাত্রে পানি দিয়ে তার ভিতর ইউরিয়া-মোলাসেস-স্ট্র খেতে দিলে ইউরিয়া খড়ের গায়ে লেগে না থেকে পানিতে দ্রবীভূত হয়ে থাকে (ইউরিয়া পানিগ্রাহী রাসায়নিক পদার্থ এবং পানিতে ইউরিয়ার দ্রবনীয়তা অত্যাধিক)। গরু সেই পানি পান করলে একবারে অনেক বেশি পরিমান ইউরিয়া গরুর পেটে প্রবেশ করে যা ইউরিয়ার সহনশীল মাত্রা অতিক্রম করে পয়জনিং মাত্রায় বিষক্রিয়া ঘটায়।
মনে রাখতে হবে গরু ধীরে ধীরে ইউরিয়া বিপাকে অভ্যস্থ হয়। তাই গরুকে যদি হঠাৎ করে ইউরিয়া খাওয়ানো হয়, এমন কি ইউরিয়া খেতে অভ্যস্থ গরুকে কয়েকদিন ইউরিয়া খাওয়ানো বাদ রাখার পর আবার উচ্চ মাত্রায় ইউরিয়া খাওয়ানো হয়, অথবা অনুমোদিত পরিমানের বেশি ইউরিয়া গরুকে খাওয়ানো হয় তবে গরুর ইউরিয়া পয়জনিং দেখা দিতে পারে।
ইউরিয়া সেবনের অনুমোদিত মাত্রা সাথে অন্যান্য কি খাবার খাওয়ানো হচ্ছে তার উপরও নির্ভর করে। খাদ্য স্বল্পতা বা নিম্নমানের খাবার যেমন কম প্রোটিন ও বেশি ফাইবারযুক্ত খাবার ইউরিয়ার সহনশীল মাত্রা কমিয়ে আনে। তখন তুলনামুলক কম পরিমান ইউরিয়াও গরুর ইউরিয়া পয়জনিং ঘটাতে পারে।
ইউরিয়ার সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রা প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য দৈনিক ০.১ গ্রাম। অর্থাৎ, ৪০০ কেজি দৈহিক ওজনের একটি গরুর জন্য দৈনিক ৩৫ গ্রাম ইউরিয়া অনুমোদনযোগ্য। অন্যান্য শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য –
- ইউরিয়ার পরিমান দানাদার রেশনের ৩% এর কম হতে হবে।
- ইউরিয়ার গ্রহণের পরিমান মোট খাদ্য (শুষ্ক পদার্থ ভিত্তিতে) গ্রহণের ১% এর কম হতে হবে।
- খাদ্যে ননপ্রোটিন নাইট্রোজেন (NPN) মোট গৃহীত প্রোটিনের তিন এর একভাগের বেশি হবে না (No more than one third of the total nitrogen intake should be NPN) ।
গরুর জন্য ০.৩-০.৫ গ্রাম/কেজি/দিন অর্থাৎ, ৪০০ কেজি দৈহিক ওজনের একটি গরুতে দৈনিক ১২০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া পয়জনিং ঘটাতে সক্ষম এবং ১-১.৫ গ্রাম/কেজি/দিন অর্থাৎ, ৪০০ কেজি দৈহিক ওজনের একটি গরুরতে দৈনিক ৪০০-৬০০ গ্রাম ইউরিয়া মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম।
গরুর ইউরিয়া পয়জনিং -এর লক্ষণ
Symptoms of Urea Poisoning in Cattle
গরুর ইউরিয়া পয়জনিং হলে –
- গরুর মুখ দিয়ে লালা ঝরতে থাকে।
- প্রচুর পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হয়।
- পেট ব্যথা হয়, ব্যথায় গরু পিঠ বাঁকা করে দেয়, পা দিয়ে পেটে লাথি মারতে থাকে, বার বার শোয় এবং ওঠে।
- পেটে প্রচুর গ্যাস হয় এবং পেট ফুলে যায়। পেট এতটাই ফোলে যে পিঠের উপর দিয়ে পেট উঠে যায়।
- প্রচন্ড শ্বাসকস্ট হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়।
- সারা দেহে পেশির কম্পন দখা যায়।
- গরু খুব দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে।
- গরু টলতে থাকে, ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
- শেষ অবস্থায় মাটিতে শুয়ে পড়ে, পা দাপাদাপি করতে থাকে, চেষ্টা করেও উঠতে পারে না।
- অধিক পেট ফোলার জন্য় শ্বাসকষ্টে এবং পেশির দুর্বলতার কারণে গরু মৃত্যুবরণ করে।
গরুর ইউরিয়া পয়জনিং -এর ল্যাবরেটরি পরীক্ষা
ল্যাবরেটরিতে রক্তে এ্যামোনিয়ার পরিমান নির্ণয় করা যায়। তবে এটি শুধু মাত্র জীবন্ত অসুস্থ পশুর জন্য প্রজোয্য। কারণ, মৃত্যুর পর রক্তের প্রোটিন দ্রুত ভেঙে এ্যামোনিয়ায় পরিনত হয়। তাই মৃত পশুর রক্ত পরীক্ষা করে বুঝার উপায় থাকে না এই এ্যামোনিয়া ইউরিয়া থেকে এসেছে না প্রোটিন থেকে এসেছে।
একই ভাবে জীবন্ত পশুর রক্ত সংগ্রহ ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনার উপর গরুর ইউরিয়া বিষক্রিয়া সনাক্তের জন্য রক্তে এ্যামোনিয়া পরীক্ষার ফলাফলের কার্যকারিতা নির্ভর করে। কারণ, দেরি হলে রক্তের প্রোটিন ভেঙে এ্যামোনিয়া তৈরি হয় এবং ভুল ফল প্রদর্শন করে। এজন্য আক্রান্ত বা সন্দেহজনক পশুর রক্ত সংগ্রহের সাথে সাথে তা লিথিয়াম হেপারিন বা ইডিটিএ (EDTA) এর মধ্যে নিয়ে বরফের উপর রাখতে হবে এবং ৩০ মিনিটের মধ্যে সিরাম আলাদা করতে হবে। ২ ঘন্টার মধ্যে পরীক্ষা করা সম্ভব হলে সিরাম 4°C তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় নচেৎ সিরাম সংগ্রহ করার সাথে সাথে হীমায়িত (frozen) অবস্থায় সংরক্ষণ ও পরিবহন করতে হবে।
সত্যিকারে এসব কারণে মাঠ পর্যায়ের ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে ইউরিয়া বিষক্রিয়া সনাক্ত করা অনেকটা অবাস্তব হয়ে দাঁড়ায়।
ইউরিয়া বিষক্রিয়ায় মৃত পশুর ময়না তদন্ত
ইউরিয়া বিষক্রিয়ায় পশুর মৃত্যুর অব্যবহিত পর পর ময়না তদন্ত করলে পেটের ভিতরে গ্যাস, মৃতদেহে সাধারণ রক্তাধিক্য (generalized congestion of the carcass), হৃদাবরণ গহ্বরে (in the pericardial sac) অধিক তরল পদার্থ, ফুসফুসে তরলাধিক্যসহ বায়ুনালীতে প্রচুর পরিমানে তুলনামুলক শক্ত সাদা ফেনা (pulmonary edema with excess stable white foam in the large airways) এবং হৃৎপিন্ডে (epicardial and endocardial) রক্তপাত দেখতে পাওয়া যাবে।
রুমেন ওপেন করার সময় এ্যামোনিয়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়।
সাধারণত রুমেনের pH নিরপেক্ষ থেকে আংশিক অম্লাত্বক (pH ৬.২-৭) হয়। ইউরিয়া বিষক্রিয়ায় pH ক্ষারীয় (pH ৭.৫ – ৮) হয়।
গরুর ইউরিয়া পয়জনিং-এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
- পেটের গ্যাস বের করে দিতে হবে। ভেটেরিনারি ডাক্তার ট্রকার-ক্যানুলার সাথে দক্ষতার সাথে পেট থেকে গ্যাস বের করে দেন। তাতে তীব্র শ্বাসকষ্ট থেকে গরু তাৎক্ষণিক রিলিফ পায় এবং মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস পায়।
- ভিনেগার বা তেতুল গোলা পানি খাওয়াতে হবে।
- ভেটেরিনারিয়ান এনে স্যালাইন, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।
- গরুকে সরাসরি ইউরিয়া খাওয়ানো বা ইউরিয়া মিশ্রিত পানি পান করানো যাবে না।
- জমিতে ইউরিয়া দেবার পর সারের বস্তাটি গরুর খাবার বা পানির পাত্রে ধুয়ে সেই পানি গরুকে খেতে দেয়া যাবে না। গ্রামাঞ্চলে এভাবে গরুর ইউরিয়া পয়জনিং হতে দেখা যায়।
- যে জমিতে মাত্র ইউরিয়া সার দেয়া হয়েছে সেই জমির পানি পান করতে দেয়া যাবে না। এতেও
- গরুর ইউরিয়া পয়জনিং হতে পারে।
- খাবার পাত্রে পানি দিয়ে তার ভিতর ইউরিয়া-মোলাসেস-স্ট্র বা ইউরিয়া-মোলাসেস ব্লক খেতে দেয়া যাবে না।
- ইউরিয়া-মোলাসেস-স্ট্র বা ইউরিয়া-মোলাসেস ব্লক আলাদা খাওয়াতে হবে।
- ইউরিয়া-মোলাসেস-স্ট্র বা ইউরিয়া-মোলাসেস ব্লক বানানোর সময় সঠিক ফরমুলা ব্যবহার করতে হবে।
- গরু যদি পূর্বে ইউরিয়া সেবনে অভ্যস্থ না থাকে তবে তাকে ধীরে ধীরে ইউরিয়া সেবনের অভ্যস্থ করতে হবে। একবার ইউরিয়া খাওয়ানো শুরু করলে তা চালু রাখতে হবে। মাঝে বাদ দিলে পুনরায় শুরু করার জন্য নিম্ন মাত্রা দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে ইউরিয়া সেবনের মাত্রা বাড়াতে হবে।
- ইউরিয়া মিশ্রিত খাবার যেন অনুমোদিত মাত্রার বেশি সেবন করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- মনে রাখতে হবে ইউরিয়ার সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রা প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য দৈনিক ০.১ গ্রাম। অর্থাৎ, ৪০০ কেজি দৈহিক ওজনের একটি গরুর জন্য দৈনিক ৩৫ – ৪০ গ্রাম ইউরিয়া অনুমোদনযোগ্য।
- ইউরিয়া ব্লক যেন আর্দ্র না হয় তা লক্ষ্য রাখতে হবে।
- কৃষি ক্ষেতে বা ঘাসের জমিতে ব্যবহারের জন্য মজুদ ইউরিয়া গবাদি পশুর নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
Leave A Comment