বর্তমান যুগে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্বের শেষ নেই।
Table of Contents
অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা
দৈনন্দিন জীবনে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমরা প্রতিনিয়ত কত কিছুর প্রয়োজন বোধ করি। এই প্রয়োজনই হলো অভাব। অভাব সীমাহীন। এই অসীম অভাব পূরণের উপকরণ কি সহজলভ্য? নিশ্চয়ই নয়। কারণ আমরা যা দিয়ে এই অভাব পূরণ করতে পারি তা হলো সম্পদ, আর এই সম্পদ সীমিত। এই সীমিত সম্পদ দিয়ে অসীম অভাব পূরণ সম্ভব নয়। তাই প্রথমে বেছে নিতে হয় গুরুত্বপূর্ণ অভাবটি, নিশ্চিত করতে হয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা একসাথে সব চাওয়া পূরণ করতে পারি না। আমাদের কোন কোন অভাব পূরণ করার জন্য অপরাপর সুযোগ ত্যাগ করতে হয়। অর্থাৎ, আমাদেরকে বিকল্প বাছাই, সুযোগ ব্যয়, প্রান্তিক ব্যয় ও প্রান্তিক সুবিধা ইত্যাদি অনুশীলন করতে হয়। এজন্য দরকার অর্থনীতির জ্ঞান। অর্থনীতির জ্ঞান ছাড়া মানুষ তার প্রাপ্ত সম্পদ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে না।
সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
অর্থনীতি পাঠের মাধ্যমে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। একটি দেশের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে কিভাবে সর্বোচ্চ উৎপাদন করা যাবে, কোন দ্রব্য কতটুকু উৎপাদন করতে হবে এবং কিভাবে তা জনগণের মধ্যে বন্টিত হবে – এসব সমস্যার সমাধান অর্থনীতি পাঠের মাধ্যমে জানা যায়। তাই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারেও অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
জাতীয় অর্থনীতিতে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
একটি দেশের উন্নয়নের সাথে অর্থনীতি সম্পৃক্ত। মুদ্রা ও ব্যাংক ব্যবস্থা, শিল্পের উন্নয়ন, বানিজ্যের প্রসার, যাতায়াত ব্যবস্থা, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাজেট ইত্যাদি সব কিছুর জন্য অর্থনীতির জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য।
পরিকল্পনা প্রনয়নে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
যে কোন কাজ সঠিকভাবে করার জন্য পূর্ব পরিকল্পনা প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ দেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা সফল হতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। সঠিক পরিকল্পনা প্রনয়ন ও দেশের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব বাদ দেয়া যায় না।।
আন্তর্জাতিক বানিজ্যে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
মানুষের প্রয়োজন মিটানোর জন্য নিজ দেশের বাহির থেকেও পণ্য ও সেবা আমদানি করতে হয়। এবং বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের জন্য নিজ দেশে উৎপাদিত পন্য ও সেবা বিদেশে বিক্রি করতে হয়। এক দেশ যেটা আমদানি করে অন্য দেশ সেটা রপ্তানি করে। এভাবে গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক বানিজ্য। এই আন্তর্জাতিক বানিজ্য পরিচালনার জন্য অবশ্যই আন্তর্জাতিক অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।
সরকারি প্রশাসনের ক্ষেত্রে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
সব দেশের সরকারকে ওই দেশের আয়-ব্যয়ের বাজেট তৈরি, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ নীতি, বানিজ্য নীতি, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, উন্নয়ন প্রকল্প প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হয়। বাস্তবে একাজ করে থাকে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তারা। তাই সরকারের পক্ষে জনগণের জন্য এই সব কার্যাবলী সুষ্ঠু ভাবে বাস্তবায়নের জন্য কর্মকর্তাদের অবশ্যই অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ব্যাবসা বানিজ্যে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
মূলত ব্যাবসায়ী সম্প্রদায় অর্থনীতির একটিভ প্লেয়ার। এরা সম্পদ ব্যবহার করে পণ্য ও সেবা উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপননের মাধ্যমে জনগণের চাহিদা পূরণে নিয়োজিত থাকে। চাহিদার তুলনায় কম পণ্য উৎপাদন করলে জনগণের চাহিদা পূরণ হবেনা অর্থাৎ সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি নিশ্চিত হবে না। আবার চাহিদার তুলনায় অধিক পণ্য উৎপাদন করলে তা অবিক্রীত থেকে যাবে এবং দাম কমে যাবে। এতে এক দিকে যেমন সম্পদের অপচয় হবে অন্যদিকে উৎপাদনকারী লোকসানের কবলে পড়বে।
উৎপাদনকারীকে জনগণের আয়স্তর বিবেচনা করে উৎপাদন খরচ সীমিত রাখতে হবে। তাই ছোট বড় যে কোন ব্যাবসা পরিচালনার জন্য অর্থনীতির জ্ঞান থাকতে হবে। বাজারে দ্রব্যের চাহিদা, যোগান, দাম নির্ধারণ, প্রান্তিক খরচ, প্রান্তিক উৎপাদন ও প্রান্তিক লাভ এসব বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য অর্তনীতি পাঠ আবশ্যক।
রাজনীতিবিদদের নিকট অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
দেশের রাজনীতিবিদের অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। তা না হলে জনকল্যাণে সরকারের নীতি নির্ধারণ ও কর্মপন্থা ঠিক করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। দেশের মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, বানিজ্যনীতি, আয় বন্টননীতি ইত্যাদি সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের গভীর জ্ঞান ও চর্চা থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব অর্থনৈতিক পরিকল্পনা থাকে, সেটি জনগনের নিকট ব্যাখ্যা করতে হয়। নির্বাচন কালে প্রতিটি দল তাদের ইস্তেহার প্রকাশ ও প্রচার করে। এতে নির্বাচনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করলে তারা কি কি অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে তার প্রতিশ্রুতি থাকে। জনগন সেগুলি বিচার করে কোন কোন অর্থনৈতিক কর্মসূচি তাদের কল্যানে আসবে তা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
সমাজকর্মীদের নিকট অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
সম্পদের তুলনায় অভাব বেশি হওয়ার কারনে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব, চিকিৎসার অভাব ইত্যাদি সামাজিক সমস্যাসমুহের সুষ্ঠু সমাধানের জন্য অর্থনীতি পাঠ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শ্রমিক নেতৃবৃন্দের নিকট অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
শ্রমিক সংঘ, শ্রম নীতি ও আইন, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা এবং শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনার জন্য শ্রমিক নেতাদের অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
বিজ্ঞানী, গবেষক ও প্রযুক্তিবিদদের ক্ষেত্রে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ছাত্র, গবেষক ও প্রযুক্তিবিদগণ অর্থনীতি বিষয়ে উদাসীন এবং অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব পোষন করেন। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে উৎপাদন বৃদ্ধি। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধিই সমাজে সর্বোচ্চ কল্যান নিশ্চিত করে না। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, চাহিদা, উৎপাদন ব্যয়, সামাজিক ব্যয়, প্রান্তিক উৎপাদন, প্রান্তিক ব্যয় ও প্রান্তিক লাভ, সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় না নিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি অনেক সময় উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়কে চরম ঝুঁকির ভিতরে ফেলে দেয়। তাই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই অর্থনীতিকে বিবেচনায় নিতে হয়। উৎপাদনকারীকে যদি বর্ধিত উৎপাদনের চেয়ে প্রযুক্তির মূল্য বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয় সেক্ষেত্রে উৎপাদনকারী লোকশানের সম্মুখীন হবেন এবং সেই প্রযুক্তি বা বর্ধিত উৎপাদন সমাজে কোন কল্যান বয়ে আনবে না। এজন্য বিজ্ঞানী, গবেষক ও প্রযুক্তিবিদগণেরও অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা –
বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য অর্থনীতির গুরুত্ব অনেক বেশি। উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা স্থির, সম্পদের গতিশীলতা আনা এবং সর্বোপরি রাস্ট্র পরিচালনা প্রতিটি ধাপে অর্থনীতির জ্ঞান অপরিহার্য।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
Leave A Comment